আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্রমশই নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা) আসন এলাকায় যেন জট বাড়তে শুরু করছে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে এই আসনটিকে কেন্দ্র করে একের পর এক প্রভাবশালী প্রার্থীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আর তাদের লড়াইয়ে জমজমাট হয়ে উঠেছে নির্বাচনী আলাপ আলোচনা। যদিও চূড়ান্ত ঘোষণার হওয়া আগ পর্যন্ত নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না শেষ পর্যন্ত কে ভোটের লড়াইয়ে থাকবেন।
তবে চূড়ান্ত ঘোষণা হওয়ার আগেই একের পর এক সম্ভাব্য প্রার্থীদের নির্বাচনের ঘোষণা দেয়াকে কেন্দ্র করে বেশ সরগরম হয়ে উঠেছে নির্বাচনী এলাকা। অনেক প্রভাবশালী নেতা সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিসেবে জানান দিচ্ছেন।
সবশেষ নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন এলাকা থেকে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডের নারায়ণগঞ্জ জেলার আহ্বায়ক ও সাবেক এমপি মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন জানিয়েছেন। ২৯ নভেম্বর বিকেলে বক্তাবলীতে এক অনুষ্ঠানে তিনি ওই ঘোষণা দেন। বলেন, আপনারা চাইলে মতামত দিলে আমি নির্বাচন করবো।
আর এই মোহাম্মদ আলী নানা কারণে নারায়ণগঞ্জে বেশ আলোচিত মুখ। একই সাথে নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারের সাথে সখ্যতার কারণে বেশ সমালোচিতও হয়েছেন তিনি। বিএনপি থেকে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে মাসুদুজ্জামান মাসুদকে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করার আগেই তাকে বিজয়ী করে নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
জানা যায়, নারায়ণগঞ্জে বিগত দিনে বহু রাজনীতিকের উত্থান হয়েছে মোহাম্মদ আলীর হাত ধরে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআই এর নির্বাচনেও কুশীলব হিসেবে কাজ করেন তিনি। ১৯৯৬ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে এমপিও হয়েছিলেন কিছুদিনের জন্য। ২০০১ সালে গিয়াস উদ্দিনকে বিএনপিতে যোগদান করানো এবং মনোনয়ন নিশ্চিত করার কাজ করেন মোহাম্মদ আলী। সে হিসেবে তার বেশ প্রভাব রয়েছে।
একই সাথে এই আসন এলাকায় নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও ফতুল্লা থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি শাহ আলমও বেশ আলোচনায় রয়েছেন। গত ১৮ নভেম্বর শাহ আলম বক্তাবলী ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ করেছেন। আর এই কর্মসূচির মাধ্যমে তিনি চমক দেখিয়েছেন। তাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের ঢল নামে। তিনি ধানের শীষ হাতে নিয়ে প্রচারণা চালান। তার বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে। বিএনপির বিপুল পরিমাণ নেতাকর্মীর সমর্থন রয়েছে তার প্রতি।
এদিকে এই আসন এলাকাতে জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক এমপি মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনও আলোচনায় রয়েছেন। তিনি এই এলাকায় ধানের শীষ প্রতিক নিয়ে নির্বাচন করতে চান। তাকে তার অনুসারীরা এলাকায় দলীয় প্রার্থী হিসেবে চাচ্ছেন। সেই সাথে মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন নিজেও এই এলাকার নির্বাচনের জন্য আগ্রহী রয়েছেন। যদিও আসন বিন্যাসের মধ্যে দিয়ে তিনি কিছুটা বিপাকে রয়েছেন।
পাশাপাশি জেলা যুবদলের সদস্য সচিব মশিউর রহমান রনিও নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা) আসন এলাকায় আলোচনায় রয়েছেন। তিনি অনেক আগে থেকেই নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা চালিয়ে আসছেন। এলাকার বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে নিজেকে জানান দিয়ে আসছেন। একই সাথে একের পর এক উঠান বৈঠক করে আসছেন। তাকে কেন্দ্র করে বেশ সরবতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২৩৭টি সংসদীয় আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের চারটি আসনে প্রার্থীর নাম রয়েছে। গত ৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ তালিকা প্রকাশ করেন।
কিন্তু নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা) আসন এলাকায় কোনো প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়নি। যার কারণে এখানে আলোচনায় থাকা জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি মুফতি মনির হোসাইন কাসেমীর অনুসারীরা ধরে নিয়েছেন তার জন্য এই আসনটি ছাড় দেয়া হবে। সে হিসেবে বিএনপির শরীক দলের প্রার্থী হিসেবে তিনিও আলোচনায় রয়েছে। তিনি নির্বাচন আলাপ আলোচনার শুরু থেকেই সরব রয়েছেন।
তবে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশ, ২০২৫ এর গেজেট জারি করেছে সরকার। এতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের জোটগতভাবে নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করার বিধান যুক্ত করা সহ বেশ কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে।
এর আগে গত ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আরপিও সংশোধন অধ্যাদেশের খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। যেখানে জোটগত নির্বাচনে নিজ দলের প্রতীকে ভোট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আর এই আদেশ জারিতে মনির হোসেন কাসেমীকে নিজ দলীয় প্রতীক খেজুর গাছ প্রতিকেই নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু খেজুর গাছ তিনি বেশি সুবিধা করতে পারবেন না বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে খেজুর গাছ প্রতিকে নির্বাচন করতে তিনি তেমন আগ্রহী নন। এই অবস্থায় খেজুর গাছ প্রতিক নিতে না চাইলে কাসেমীকে নিজ দল ত্যাগ করতে হবে। এমনটা গুঞ্জনও রয়েছে।
এর আগে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের শুরু থেকে নারায়ণগঞ্জ-৪ সংসদীয় এলাকার বিএনপির নেতাকর্মীরাসহ প্রায় সকলেই নিশ্চিত ছিলেন এই আসনে ২০ দলীয় জোটের পক্ষে বিএনপির প্রার্থীকেই ধানের শীষের প্রতিক দেয়া হবে। কিন্তু চূড়ান্ত বাছাই পর্বে হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসেন জমিয়ত উলামার মনোনীত প্রার্থী মাওলানা মনির হোসাইন কাশেমী। সেই সাথে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে দিনভর নানা জল্পনার পর বিকেলে তার হাতে তুলে দেওয়া হয় ধানের শীষের মনোনয়ন পত্র।
অথচ তার বিরুদ্ধে ছিলো তৎকালিন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের সংসদ সদস্যের সাথে আঁতাতের অভিযোগ। মূলত স্থানীয় ক্ষমতাসীনদের সমর্থনেই তার বেড়ে উঠা এবং একই সাথে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ারও ইচ্ছা পোষণ করেন। এমনকি বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরাসহ অনেকেই তাকে চিনতেনই না।
বিএনপির নেতাকর্মীদের অভিযোগ ছিলো-বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোটের শরিক দল জমিয়তে উলামা হলেও জমিয়ত নেতা মনির হোসাইন কাসেমীকে কেউই চিনতো না। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের শুরুতেও তার কোন আলাপ আলোচনাই ছিল না। সংসদীয় এলাকাতেও তার তেমন একটা পরিচিত নেই। অনেকের কাছেই তিনি অপরিচিত। তারপরেও তাকে ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে মনোনয়ন দেয়া হয়।
কিন্তু এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় বিএনপি স্থানীয় পর্যায়ের দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে পরামর্শ না করেই মনির হোসাইন কাসেমীকেই ২০ দলীয় জোটের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করা হয়। জোটের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষ প্রতিক পাওয়ার পরেও জেলা ও মহানগর বিএনপির নেতাকর্মীদের সাথে তিনি কোন যোগাযোগ করেনি। এর আগেও তিনি যোগাযোগ করেনি। ফলে ধানের শীষ প্রতিকের প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও মনির হোসাইন কাসের্মীকে প্রায় অনেকটাই বয়কট করেছিলেন নারায়ণগঞ্জ বিএনপির নেতাকর্মী।
সব মিলিয়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা) আসন এলাকা বেশ জটিল হয়ে উঠেছে নির্বাচনী হিসেব নিকেস।








































আপনার মতামত লিখুন :