নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান থেকে সিটি করপোরেশনের তিনবারের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। প্রায় প্রতিটি নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রতিযোগিতামূলক। কাকতালীয়ভাবে প্রতিটি নির্বাচনেই নারায়ণগঞ্জ বিএনপির একাংশের নীরব সমর্থন পেয়েছেন আইভী। বিনিময়ে আইভীও ঠিকাদারি থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজে বিএনপির কাউন্সিলর এবং ঠিকাদারদের পাশেই রেখেছেন। কিন্তু ৫ আগস্টের পর যেন রাতারাতি এসব ভুলে গেছে বিএনপির নেতাকর্মীরা। নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে জনপ্রতিনিধি হবার দায়ে সমালোচনায় বিদ্ধ করছেন প্রতিনিয়ত।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আইভী এখন পর্যন্ত জনপ্রতিনিধি হিসেবে চারবার নির্বাচিত হয়েছেন। প্রথম পৌরসভা মেয়র হবার পেছনে বিএনপির তৎকালীন প্রভাবশালী নেতা তৈমূর আলম খন্দকার ও তার বলয়ের একচ্ছত্র সমর্থন ছিলো। বিএনপির একাংশের ব্যাপক সহযোগিতায় মেয়র হন আইভী। ২০১১ সালের নির্বাচনে আইভী, শামীম ওসমান ও তৈমূর আলম খন্দকার নির্বাচনে অংশ নেন। আইভী সেবার আওয়ামী লীগের নমিনেশন থেকে বঞ্চিত হওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন। নির্বাচনের আগের দিন বিএনপি ও জামায়াত আইভীকে সমর্থন দিয়ে তৈমূরকে সরিয়ে দেয়। ফলাফল বিপুল ভোটে শামীম ওসমানকে পরাজিত করে জয়লাভ করে আইভী।
২০১৬ সালের মেয়র নির্বাচনে আইভীর বিপক্ষে শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে ভাবা হচ্ছিলো গিয়াস উদ্দিন এবং তৈমূর আলম খন্দকারের কথা। কিন্তু তাদের কেউই নির্বাচনে আগ্রহী ছিলেন না। কারণ উভয়ের সাথেই আইভীর ছিলো সুসম্পর্ক। সেসময় অপেক্ষাকৃত অচেনামুখ সাখাওয়াত হোসেন খানকে বিএনপি নমিনেশন দেয়। বিএনপির বড় একটি অংশ তাকে সমর্থন না দিয়ে নীরব থাকে। বিএনপির একাংশের অসহযোগীতা এবং ভোটারদের অনেকের কাছে অচেনামুখ হওয়ায় পরাজিত হন সাখাওয়াত হোসেন খান।
সবশেষ ২০২২ সালের নির্বাচনে আইভীর প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়ান তৈমূর আলম খন্দকার। তবে বিএনপি থাকে নমিনেশন দেয়নি। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেই নির্বাচন করেন তৈমূর। সেসময় স্পষ্ট একটি বার্তা ছড়িয়ে যায় যে শামীম ওসমানের পরামর্শেই তৈমূর আইভীর বিপক্ষে লড়ছেন। এমন বার্তা পেয়ে বিএনপির একাংশ নীরবে আইভীকে সমর্থন দেয়। বিশেষ করে সিটি করপোরেশনের বিএনপিপন্থী ঠিকাদার ও একাধিক কাউন্সিলর সরাসরি আইভীকে সমর্থন দিয়ে কাজ করতে থাকে।
প্রায় চারটি নির্বাচনেই নারায়ণগঞ্জের বিএনপির একটি বড় অংশের সরাসরি এবং নীরব সমর্থন পেয়ে আইভী জয় পেয়েছেন মেয়র পদে।
অন্যদিকে আইভীও বিএনপিপন্থি ঠিকাদারদের কাজের সুযোগ করে দিয়েছেন- এই অভিযোগে শামীম ওসমানের বলয় সারাবছর আইভীকে দোষারোপ করে বিএনপি জামায়াতের এজেন্ট আখ্যা দিত। অন্যদিকে শামীম ওসমানকে প্রতিহত করার জন্য আইভীর প্রতি থাকতো সমর্থন। কিন্তু এখন সেই আইভীকেই নৌকার জনপ্রতিনিধি হিসেবে বিএনপির নেতাকর্মীরা ব্যাপক সমালোচনা করে যাচ্ছেন।
তবে ঠিক নৌকার জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েও বহাল তবিয়তে আছেন এবং বিএনপির নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে বিএনপিতে ফের প্রবেশ করতে মরিয়া হয়ে আছেন কুতুবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টু। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকলেও তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেনা। বিএনপি থেকে সরে গিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান এবং নৌকা প্রতীক নিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবার পরেও তাকে নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যাথা নেই বিএনপির নেতাকর্মীদের। উল্টো তাকে বিএনপিতে ফেরাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। কেবল একাই বিরোধীতা করে যাচ্ছেন গিয়াস উদ্দিন ও তার অনুসারীরা।
সূত্র বলছে, ‘শামীম ওসমানের ঘনিষ্ট চেয়ারম্যানদের একজন সেন্টু। চেয়ারম্যান সেন্টু ও শামীম ওসমানের ডানহাত হিসেবে পরিচিত শাহ নিজাম পুরো ফতুল্লা ও কুতুবপুরে ব্যাপক ভুমিদস্যুতা চালিয়েছেন। জায়গা কেনাবেচা এবং জমি নিয়ে বিচার আচার করতেন এই দুজন। দুই মানিকজোড় আরও পোক্ত হয় সেন্টু আওয়ামী লীগে যোগদানের পর। যেই সেন্টু ৫ আগস্টের আগে আন্দোলন প্রতিহত করার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছে। সেই সেন্টু এখন রয়েছে বহাল তবিয়তে। তাকে প্রতিহত করতে বিএনপির নেতাকর্মীদের কোন তোড়জোর নেই। নৌকার জনপ্রতিনিধি হিসেবে আইভীর ব্যাপক সমালোচনা করলেও নৌকার চেয়ারম্যান সেন্টুকে নিয়ে মাথাব্যাথা নেই তাদের। অথচ দুজনেই বিএনপি সমর্থকদের ভোটে নির্বাচিত হয়েছে বিগত সময়ে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেন্টুর বিপরীতে কুতুবপুরে চেয়ারম্যান পদে দাঁড়াবার মত শক্ত প্রার্থী এখনও তৈরি হয়নি। তার সেন্টুর বিরোধীতা করে খুব বেশি লাভ হবে না এটা পরিষ্কার। অন্যদিকে নাসিক মেয়র পদে মেয়র হবার জন্য বিএনপির একাধিক প্রার্থী মুখিয়ে আছেন। একাধিকবার বিজয়ী হয়ে শক্ত অবস্থান তৈরি করা আইভীকে সরিয়ে দিতে পারলে বিএনপির অন্যান্য প্রার্থীদের জয় পাওয়া সহজ হবে। এই ভোটের রাজনীতির লড়াইয়ে আইভী নৌকার জনপ্রতিনিধি হয়ে সমালোচনার শিকার। আর সেন্টু নৌকার জনপ্রতিনিধি হয়ে বহাল তবিয়তে আছেন।
আপনার মতামত লিখুন :