‘২০২১ সালে তখন সরকার বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। হেফাজত নেতা মুফতি বশিরউল্লাহ তখন গ্রেপ্তার। অনেক আলেম ওলামারা তখন পলাতক। এক ভীতিকর পরিস্থিতিতে কয়েকজন আলেমের মোবাইলে ফেরদাউসুর রহমানের ফোন। জানান, র্যাবে কর্মরত একজন এএসপি তাকে খুঁজছে। তার নাম্বার ট্র্যাকিং করছে। সমাধান চাইলে যেন দ্রুত জানায়। ফেরদাউসুর সেটা মিমাংসা করে দিবে। নতুবা গ্রেপ্তার করানো হবে। নির্যাতন করবে।’ এভাবেই আলেমদের ফোন করে ভয়ভীতি দেখাতেন ফেরদাউস। তখন ওই র্যাব কর্মকর্তার সোর্স হিসেবে তিনি কাজ করতেন। হেফাজত ও জমিয়তের কোন নেতা কি করছেন, কি কি পরিকল্পনা, কার সঙ্গে কার যোগাযোগ মূলত এসব তথ্য পাচার হতো তখন। মিমাংসার নামে কারো কারো কাছ থেকে মোটা অংকের টাকাও নেওয়া হয়েছিল। বিগত সময়ে আন্দোলনে অনেক আলেম ওলামারা যখন ছিলেন ভীত তখন শামীম ওসমানের ‘ছোট ভাই’ পরিচয়ে বুক ফুলিয়ে চলতেন ফেরদাউসুর রহমান।
শুধু প্রশাসন না বরং রাজনীতিবিদদের কাছেও তিনি একজন ভয়ঙ্কর গুপ্তচর হিসেবে পরিচিত পেয়ে গেছেন। জমিয়ত নেতা মাওলানা মনির কাশেমী ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে এমপি প্রার্থী হয়েছিলেন। তখন সার্বক্ষনিক তাঁর সঙ্গী ছিলেন ফেরদাউস। অভিযোগ আছে, ওই সময়ে প্রতি রাতেই শামীম ওসমানের সঙ্গে দেখা করে কাশেমীর সকল তথ্য পাচার করতেন তিনি। ৫ আগস্টের আগে শামীম ওসমান ও তার ডানহাত খ্যাত শাহ নিজামকে দিয়ে গৌরীপুরের এক ব্যক্তির স্বর্ণ আত্মসাতের ঘটনায় যুবলীগ নেতা সোনারগাঁয়ের সোহাগ রনিরকে চাপ দিয়ে শালিস মিমাংসা করান। গরু চুরির মামলাও নিস্পত্তি করতে ওসমান পরিবারের সহযোগিতা নেন।
বিএনপির একাধিক নেতা জানান, মনির কাশেমীর আস্থাভাজান পরিচিতি পাওয়া ফেরদাউস এখন নিয়মিত সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দিন, বিএনপি নেতা শাহ আলম ও দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদের দুয়ারে যান। এক নেতার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে আরেক নেতার কাছে পৌছে দেন তিনি।
সম্প্রতি গিয়াসউদ্দিনের সঙ্গে হিরাঝিলে স্কুলে দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করেন ফেরদাউস। সেখানে তিনি কাশেমীর নির্বাচনের কিছু কৌশল জানিয়ে দেন। সেদিন বৈঠক শেষেই রাতে খবর রটে যায় শামীম ওসমানের সঙ্গে কাশেমীর মুঠোফোনে কথা হয়েছে। যে কোন মূল্যে গিয়াসউদ্দিনকে ঠেকাতে পরামর্শ দেন শামীম ওসমান। অপরদিকে শাহ আলমের সঙ্গেও দেখা করে তাঁকে স্বতন্ত্র নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পরামর্শ দেন ফেরদাউস।
তবে ফেরদাউস দাবী করেছেন তথ্যগুলো পুরোপুরি সত্য না। তিনি জানান, আলেপউদ্দিন তখন র্যাবের এএসপি ছিলেন। তিনি নানা কারণে তাকে ফোন দিতেন। কেউ ফোন দিলে তো আর তাকে না করা যায় না। রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। নানা অনুষ্ঠান কিংবা সামাজিকতার খাতিরে অনেকের সঙ্গেই আমার দেখা হয়। আমি কোন গুপ্তচর না। এগুলো আপনাদের মিডিয়ার বাড়াবাড়ি।
প্রসঙ্গত নারায়ণগঞ্জে বিগত দিনে ওসমান পরিবারের পক্ষে কাজ করা ও নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা প্রার্থীদের পক্ষে থেকে রীতিমত ‘ওসমানীয় হেফাজত’ রূপান্তর হয় ইসলামী সংগঠনটি। বিভিন্ন ইস্যুতে তৎকালীন মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিরুদ্ধে সভা সমাবেশ ও হাত পা ভেঙে শীতলক্ষ্যায় ভাসিয়ে দেওয়ারও হুমকি এসেছিল। সরকারী জায়গা দখল করে নির্মিত নম পার্কের রাহবার নিজামের ডেরায় বসে দিনরাত কূটকৌশল করে শামীম ওসমানের ‘ছোট ভাই’ উপাধি পাওয়া নেতারা এখন মিশে যাচ্ছে বিএনপির সমর্থকদের সঙ্গে।
সদর উপজেলার আলীরটেক ইউনিয়ন পরিষদের গত নির্বাচনে প্রথমে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন পান সাবেক চেয়ারম্যান মতিউর রহমান। কিন্তু জাকির হোসেনও নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে আগ্রহী ছিলেন। এতে শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমানের সঙ্গে মধ্যস্ত করেন ফেরদাউসুর রহমান। মাঝখানে কাজে লাগান অস্ত্রধারী ক্যাডার শাহ নিজামকে। এ নিজামের পরিচালনাধীন নম পার্কে নিয়মিত আড্ডা বসাতেন তিনি। ছিলেন বুলবুল নামের একজন। মতিউর রহমানকে চাপ প্রয়োগ করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো হয়। মতি তখন নিজকে অসুস্থ দাবি করে নির্বাচন থেকে সরে যান। দ্বিতীয় দফায় কৌশলে জাকির হোসেনের জন্য নৌকা প্রতীকে এনে দেন শামীম ওসমান। জাকির হোসেনের ওই নির্বাচনে মাওলানা ফেরদাউসুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে নৌকা প্রতীকে মনোনযন জমা দেন জাকির হোসেন। নির্বাচনে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের নিয়ে জাকির হোসেনের নৌকার পক্ষে শোডাউন করেন এবং নির্বাচনী কাজ করেন।
শুধু সমঝোতা না বরং হুমকিতেও পারদর্শী ফেরদাউস। শহরের চাষাঢ়ায় বাগে জান্নাত মসজিদে দাঁড়িয়ে ‘পিঠের চামড়া’ তুলে নেওয়ার মত হুংকার হুশিয়ারী দিয়েছেন ফেরদাউসুর রহমান। আসরের আজানের প্রাক্কালে তিনি বলেন, ‘যারা আমাদের বিরোধীতা করবে তাদের পিঠের চামড়া তুলে নিব।’
এর আগে তিনি আইভীর হাত পা ভেঙে শীতলক্ষ্যায় ভাসিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী মাসুদুজ্জামানের পক্ষে এবার ‘পিটিয়ে তক্তা’ বানানোর হুশিয়ারী দিয়েছেন হেফাজতে ইসলামের নেতা মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান।
আপনার মতামত লিখুন :