নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে অন্তত তিনটি গণপিটুনিতে হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। মাত্র ২৩ দিনের মধ্যে তিনটি গণপিটুনির ঘটনা যেমন আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তেমনি প্রশ্ন উঠেছে এসব ঘটনা আদৌতেই অপ্রত্যাশিত নাকি পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের অংশ। যার মাধ্যমে বার্তা দেয়া হচ্ছে ডাকাত দল এবং অপরাধীদের মাঝে।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার ডাকাত অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত। চরাঞ্চল ও দুর্গম এলাকা হওয়ায় ডাকাতি এই অঞ্চলে নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। মাঝে মধ্যে এসব ডাকাতদের বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযান চালালেও ৫ আগস্টের পর থেকে এখানকার আইন শৃঙ্খলার অবস্থা তেমন সন্তোষজনক নয়। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা এখন সংঘবদ্ধ হয়ে এখানে ডাকাতি করছে এমন অভিযোগও বিস্তর। সেই সাথে থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র ডাকাতদের হাতে চলে যাবার শঙ্কা রয়েছে প্রবল।
এদিকে অব্যহত ডাকাতির কারনে স্থানীয়রা অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। ধারনা করা হচ্ছে এসব কারনেই গণপিটুনির মত নির্মম প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে স্থানীয়দের মাঝে। যার অন্যতম ব্যার্থতার দায় বর্তায় স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের উপরেও।
গত ৮ সেপ্টেম্বর আড়াইহাজার উপজেলার ব্রাহ্মন্দী ইউনিয়নের প্রভাকরদী গ্রামে আয়নাল নামে এক ব্যক্তিকে ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। আয়নাল আড়াইহাজারে চিহ্নিত ডাকাত সদস্য। ঘটনার রাতে একটি ইজিবাইকে ডাকাতির অভিযোগ উঠলে গ্রামবাসী জড়ো হয়ে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। আয়নালের বিরুদ্ধে ডাকাতি, ধর্ষণ সহ ৭ টি মামলা ছিলো।
একই মাসের ২৯ সেপ্টেম্বর একই ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সোহেল ওরফে ফেন্সি সোহেলকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার দিন সকালে বালিয়াপাড়া এলাকায় এক ব্যক্তির বাড়ি থেকে চাঁদা আদায় করতে গেলে প্রথমে কথা কাটাকাটি ও পরে তাকে স্থানীয়রা ঘিরে ধরে গণপিটুনি দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় সে। সোহেল স্থানীয় ইউপি সদস্য হলেও চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী। তার বিরুদ্ধে ১৫ টির বেশি হত্যা, মাদক ও সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলা রয়েছে। তার উপর আগে থেকেই গ্রামের মানুষ ক্ষুব্ধ ছিলো। চলতি বছরের জুন মাসেও র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলো সোহেল। জেল থেকে বেরিয়ে ফের উপদ্রব শুরু করে সে।
সবশেষ ১ অক্টোবর রাতে আড়াইহাজারের বিশনন্দী ইউনিয়নের দড়ি বিশনন্দী এলাকায় ডাকাতিকালে এলাকাবাসীর গণপিটুনিতে নবী হোসেন নামে এক ডাকাতকে হত্যা করা হয়। রাতে বিশনন্দি এলাকার ইলিয়াস নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে ১০/১২ জন ডাকাতি করতে এসে পরিবারের সদস্যদের উপর আক্রমন করে। বেশ কয়েকজনকে কুপিয়ে জখম করার পর স্থানীয়রা মাইকে ঘোষণা দিয়ে তাদের ঘেরাও করে। উত্তেজিত জনতা এক ডাকাত সদস্যকে আটক করে গণপিটুনি দেয়। বাকিরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, মামলায় গ্রেপ্তার কিংবা জেলে পাঠানোর পরেও অপরাধ কমছে না। উল্টো জামিনে বেরিয়ে এসে ফের ডাকাতি করছে এই ডাকাত সদস্যরা। এমন অবস্থায় এলাকাবাসি বাড়তি সতর্কতার অংশ হিসেবে মসজিদের মাইক ব্যবহার করতে শুরু করে। ডাকাতের উপস্থিতি পাওয়া মাত্র জড়ো হয়ে গণপিটুনি দিচ্ছে। এমনকি হত্যা করে ফেলা হয় যেন অন্যান্য ডাকাত সদস্যদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয় বা মৃত্যুভয় কাজ করে। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিজেরাই তৈরি করছেন। এটি অনেকটা পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের শামিল।
নিরাপত্তা বোদ্ধারা বলছেন, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির অংশ হিসেবেই একের পর এক গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে এই থানাটিতে। এক মাসের কম সময়ে তিনটি গণপিটুনিতে হত্যাকান্ড স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন তোলে এলাকার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে। যখন মানুষ বুঝতে পারে আইনের হাতে সোপর্দ করলেও এর থেকে স্থায়ী সমাধান পাওয়া যাবে না, কিংবা উল্টো তার নিজের নিরাপত্তা ঝুকিতে থাকবে, তখন তারা আইন হাতে তুলে নেয়। এই ঘটনাগুলো রোধ করা না গেলে অনেক নিরপরাধ মানুষও কেবল সন্দেহের বশে হত্যাকান্ডের শিকার হতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :