নারায়ণগঞ্জে বর্তমান আলোচিত জাকির খান দুই দশকের পলাতক জীবন ও আড়াই বছরের জেল জীবনের পর মুক্তি পান গত ১৩ এপ্রিল। ৭০ দিন বেশি সময়ে কারামুক্ত জীবনে রাজনৈতিক সৈনিক নিয়ে শহর-বন্দর ও ঢাকায় চুষে বেড়াচ্ছেন তিনি। এদিকে দ্রুত সময়ে মাঠে নামছেন পদবিহীন এই নেতা। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৩১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ঘরে ঘরে লিফলেট ও আগামীতে ধানের শীর্ষের ভোট দেয়ার আহবান জানাতে কিং খান নামছেন। একই সাথে লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে শহর-বন্দর আসনের ওয়ার্ড ভিত্তিক নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করে দলীয় মনোয়ন চাইবেন।
জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আলোচিত জাকির খান বিগত সময়ে আলোচিত সমালোচিত ছিলেন। হত্যা, চাঁদাবাজি, অস্ত্র ও মাদকসহ মোট ৩৩টি মামলার আসামি হয়ে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকা ৫১ বছর বয়সী তিনি। ৩১টি মামলা খালাস ও ২টি মামলায় জামিনে মুক্তি হয়ে ১৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পান। মুক্তি পেয়েই বিশাল শোডাউন দিয়ে ঘোষণা দেন তারেক রহমানের ৩১ দফা বাস্তবায়নের। জাকির খান বলেন, তারেক জিয়ার ৩১ দফা দাবি আজকের এই দিনে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওয়াদা করছি যে, আমরা বাস্তবায়ন করবই করব। আর আমাদের মুসলিম উম্মার জন্য ফিলিস্তিনে যে ঘটনা হচ্ছে, আমরা সবাই মিলে যদি এটার প্রতিবাদ না করি, তাহলে আমরা আর মুসলমানের কাতারে রইলাম না।
কারামুক্তি পর নারায়ণগঞ্জবাসীল উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমার শরীরের চামড়া দিয়ে যদি জুতা বানাই দেই, তাহলেও নারায়ণগঞ্জবাসীর ঋণ কখনো শোধ করতে পারব না। আমরা রাজনৈতিকভাবে যেভাবে হেয় পতিপন্ন হয়েছি শেখ হাসিনার গভর্নমেন্টের মাধ্যমে, আমাদের নেক্সট জেনারেশন এ ধরনের সম্মুখীন যেন না হয়। এ জন্য আমরা সর্বোচ্চ ও সব ধরনের ভূমিকা রাখব।
আত্মগোপন ও জেল জীবনের কারণে দীর্ঘদিন সরাসরি রাজনীতিতে না থাকলেও তার কর্মীরা সক্রিয় ছিল সরকার বিরোধী আন্দোলনে নিয়মিতভাবে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ব্যানারে তার কর্মীরা আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতো। এই দীর্ঘসময়েও অনুসারীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল তার। কারামুক্তির পর বিশাল শোডাউনে তার প্রমাণ মেলে। রাজনীতিতে তার প্রভাব এখনো কতখানি তা বুঝিয়ে দিয়েছেন একসময়ের ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’র তকমা পাওয়া জাকির খান।
২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শহরের মাসদাইর এলাকায় নিট পোশাক ব্যবসায়ী নেতা সাব্বির আলম খন্দকার খুনে পর বিদেশে পাড়ি জমান জাকির খান। প্রথমে থাইল্যান্ড, ভারত ও পরে অন্যান্য দেশে অবস্থান করেন। গত ২০২২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-১১।
নব্বইয়ের দশকে জাতীয় পার্টির ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্র সমাজ থেকে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলে আসা জাকির হোসেন খান ওরফে জাকির খান। এক সময় শহরের ‘ক্যাডার’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার আগে তিনি জেলা ছাত্রদলের সভাপতি হন। এরপর থেকে তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলা মহানগর বিএনপি বা ওয়ার্ড কমিটির সদস্য হতে পারেনি।
১৯৯৯ সালে সালে জাকির জেলা ছাত্রদলের সভাপতি হন। তখন শহরের ডিআইটিতে তাকে সংবর্ধনাও দেওয়া হয়। বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কয়েক দফা জেলও খাটেন তিনি। গত ৫ অগাস্ট শিক্ষার্থী-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে শহরের পরিবহন, ঝুটসহ বিভিন্ন সেক্টরে জাকির খানের অনুসারীদের দখল ও আধিপত্য বিস্তারের অভিযোগ ওঠে। গত ২২ সেপ্টেম্বর একটি পরিবহন দখলকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জ শহরের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে জাকির খানের অনুসারীদের সঙ্গে বিএনপির আরেকটি পক্ষের সংঘর্ষ হয়। এই সময় গুলিও চলে।
জাকিরের সঙ্গে এক সময় চরম দ্ব›েদ্ব জড়ান নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান। টানবাজারর যৌন পল্লী উচ্ছেদের পর অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে জাকির খানের পরিবার, যা তাদের দ্ব›দ্ব তীব্র করে। আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের পর শামীম ওসমান শহর ছেড়ে পালানোয় জাকির খানের প্রতিদ্ব›দ্বীতার চ্যালেঞ্জ কমেছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জাকির খানের নাম ব্যবহার করে চাঁদা দাবি ও হুমকি দেওয়ার একটি অডিও কল রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। তবে অডিও কল রেকর্ডের চাঁদা দাবি করা ব্যক্তিটি জাকির খানের নয় বলে জানিয়েছেন জাকির খানের আইনজীবী রাজীব মন্ডল। সম্মপ্রতি এই ঘটনায় এক মিনিট ১৫ সেকেন্ডের একটি অডিও কল রেকর্ড ভাইরাল হয়। এ নিয়ে সব মহলে চলছে নানা আলোচনা সৃষ্টি হয়।
অডিও কল রেকর্ডে নারাণগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জাকির খান পরিচয় দিয়ে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবী করে এক অজ্ঞাত ব্যবসায়ীকে ফোন করে বলেন, ‘৫ মিনিটের মধ্যে তুই আমার বাসায় না আসলে আমার পোলাপান তোর বাসায় যাবে। তুই চ্যালেঞ্জ করছোস না আমার সাথে। তোকে দেখি ওরা বাঁচাইতে পারে কিনা। তোকে আমি দেখতেছি। তুই ৫ মিনিটের মধ্যে আয়, তোর টাকা লাগবে না। তারপর দেখ তোকে কি করি। তুই মনে করছোস কে বা কারা ফোন দিছে। আমি তোকে দেখতেছি।’
এর প্রতি উত্তরে ফোনের ওপাশে থাকা অজ্ঞাত ব্যবসায়ী বলেন, আমার জাকির ভাই ২০ হাজার টাকা নেওয়ার লোক না। চাষাঢ়ায় তো অনেক জ্যাম, আমার আসতে সময় লাগবে। আমি একটু পরে আসতেছি। অডিও কল রেকর্ডে নারাণগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জাকির খান পরিচয় দেয়া ও ব্যবসায়ীর পরিচয় জানা যায়নি।
এদিকে এ ঘটনায় ৪ জুন নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদারের কাছে লিখিত অভিযোগ পত্র দিয়ে সাক্ষাৎ করেছেন আইনজীবী রাজিব মন্ডল সহ নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির আইনজীবীরা।
আপনার মতামত লিখুন :