প্রয়াত সাবেক এমপি নাসিম ওসমানের একমাত্র ছেলে আজমেরী ওসমানের বাহিনীর সদস্য ছিলেন। মটর সাইকেলে ঘুরে বেড়াতেন বিশাল বহর নিয়ে। আজমেরী ওসমানের বহরেও থাকতো সে। আর সেই বদৌলতেই বেপরোয়া হয়ে উঠেন ইভান। ইসদাইর ও আশপাশ এলাকার বিশাল একটি গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রক ছিলেন। ধরাকে সরা জ্ঞান করতো। সে কারণেই এলাকার অনেকের কাছেই এক প্রকার আতঙ্কের নাম ছিল ইভান। ইতোপূর্বে অন্তত ডজনখানেকবার গ্রেপ্তার হলেও নিজেকে শুধরাতে পারেনি। বরং একের পর এক অপকর্ম করেছেন। কখনো হামলা, মারধর, ছিনতাই ছিল তার বাহিনীর নিত্যদিনের কর্মকাণ্ড।
৫ আগস্টে হাসিনার সঙ্গে আজমেরী ওসমানও দেশ ছাড়েন। কয়েক মাস নিজেকে আড়াল করে রাখে সে। কিন্তু আবারো কয়েক মাস ধরে সেই পুরানো চরিত্রে ফিরে সে। ক’ মাস আগেও ইসদাইরে একই পরিবারের তিনজনকে মারধর করে ইভান। একজনের পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়। ওই ঘটনায় মামলাও হয়েছিল। শফিকুল ও বাবু নামের এ তিন সহোদরের হাত পায়ের রগ কেটে দেওয়ার জের ধরে ইভনের সঙ্গে বিরোধ ছিল। ৭ সেপ্টেম্বর রাতে ইসদাইরে ওসমানী পৌর স্টেডিয়ামের সামনে ইভানকে রাস্তায় পান তারা। মটরসাইকেল থেকে নামিয়ে একের পর এক কুপিয়ে জখম করা হয়। লুটে পড়ে মাটিকে। প্রথমে খানপুর হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। রাত সাড়ে ১১টায় মারা যান।
জানা যায়, ইভনের বিরুদ্ধে হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। মাদকসক্ত ইভনকে নিরাময় কেন্দ্রে পাঠালেও সেখান থেকে ফিরে সে আবার মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে এবং সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। তার নেতৃত্বে সুগন্ধা আবাসিক এলাকায় একটি ‘কিশোর গ্যাং’ চলে। রাসেল (১৮) নামে এক কিশোর ফুটবলার হত্যা মামলার আসামি ইভন। তবে ওই মামলার এখন বিচারকার্য সম্পন্ন হয়নি। সে ইসদাইর সুগন্ধা এলাকায় রীতিমতো ত্রাস সৃষ্টি করেছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
এলাকায় প্রকাশ্যে মারপিট, ছুড়ি হাতে ধাওয়া পালটা ধাওয়া, নেশার আসর, নিজ বাড়িতেই টর্চার সেলে নির্যাতন সহ এমন কোনো অভিযোগ নেই যা তাঁর বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর নেই।
কয়েক মাস আগে ইসদাইর এলাকায় লেপ তোষক বিক্রেতার দোকানে হামলা চালিয়ে ধারালো ছুরির ভয় দেখিয়ে এক লাখ ৯৩ হাজার টাকা সহ ক্যাশ বাক্স লুটে নিয়েছে ইভন ও তার সহযোগীরা।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ইভন তার সহযোগীদের নিয়ে কামাল হোসেনের দোকানে এসে ধারালো অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ক্যাশবাক্স থেকে ১ লাখ ৮১ হাজার টাকা ও পকেট থেকে ১২ হাজার টাকাসহ দোকানের ক্যাশ বাক্স লুটে নেয়। তখন কামাল হোসেন ডাক চিৎকার করলে ইভন ও তার সহযোগীরা তাকে মারধর করে হত্যার হুমকি দিয়ে চলে যায়।
এর আগে ৬ ডিসেম্বর ইসদাইর এলাকা থেকে ইভন ও তার দুই সহযোগী সাদ্দাম এবং সাব্বিরকে ৫০ পিছ ইয়াবাসহ গ্রেফতার করে পুলিশ। এঘটনায় কিছুদিন জেল খেটে জামিনে মুক্তি পায় দুই সহযোগীসহ ইভন।
ইভানের পরিচয়
এলাকাবাসীর মাধ্যমে জানা যায়, ইসদাইরের সুগন্ধা গেইটের পাশে নিজেদের পাঁচতলা বাড়িতে নিজের পরিবারের সাথে থাকে। তিন ভাইয়ের মধ্যে ইভান মেজো। ঠিকমত পড়ালেখা না করায় স্কুল জীবন থেকেই ঝড়ে পরে সে। ছোট বেলা থেকেই পড়ালেখার থেকে বেশি ‘বড় ভাই ছোট ভাই’ নিয়ে মারপিট নিয়েই মেতে থাকতো ইভান। বাবা বাবুর কাছে এ নিয়ে বিচার দিলে সে এসব কাজে ছেলেকে আরো উৎসাহ দিতো বলেও অভিযোগ রয়েছে। এভাবেই ছোট ছোট অপরাধ থেকে কোনো বাধা না পেয়ে অপ্ররিরোধ্য হয়ে উঠতে থাকে সে।
কিশোর গ্যাং তৈরী
ইভানের কথামত যারা কাজ না করতো এলাকার সেই ছেলেকেই নির্যাতন করতো সে। আর যারা কাজ করতো তাদেরকে নিয়ে সে তাঁর বাসার ৪র্থ ও ৫ম তলায় নেশার আসর বসাতো। আর এভাবেই এলাকার ছেলেদেরকে তাঁর দিকে আকৃষ্ট করে সে বনে যায় এলাকার ‘বড় ভাই’। এলাকার উঠতি বয়সের ছেলেদের নিয়ে সে তৈরী করে নিজের গ্যাং। এই গ্যাংয়ের সদস্য এখন প্রায় ৩০ থেকে ৪০জন। নিজেদের পাঁচতলা বাড়ি থাকলেও সেই বাসার ২য় তলায় শুধু তাঁরাই থাকতো। মাঝে মাঝে না জেনে ভাড়াটে আসলেও অল্প দিনেই ইভনের নানা কর্মকাণ্ডের কারণে চলে যেত তাঁরা। যে কারণে অধিকাংশ সময় সেই বাসা ফাঁকা থাকতো। এই বাসার ৪র্থ তলায় এবং ৫ম তলায় নেশার আসর ও টর্চার সেল তৈরী করে ইভান। সেখানে ইভানের অবাধ্যদের উপর নির্যাতন চালাতো সে।
প্রথম বড় অপরাধ
ছোট বেলা থেকে মারপিট ছিল তাঁর নিত্য দিনের কাজ। কিছুদিন পর পরেই অন্যান্য গ্রুপের সাথে ধারালো অস্ত্র নিয়ে করতো ধাওয়া পালটা ধাওয়া। এভাবে কত যুবককে মেরে আহত করেছে তাঁর হিসাব গুনে শেষ করতে পারেন না এলাকাবসী। মূলত এই এলাকায় যত মারপিট সব ইভানকে কেন্দ্র করে বলে জানান এলাকাবাসী। ‘ছোট ভাই বড় ভাই’ কেন্দ্র করে ২০১৩ সালে ফুটবলার রাসেলকে প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে সে। সেই হত্যার বিচার না হওয়ায় এলাকার মানুষের মধ্যে আরো বেশি ভয় তৈরী হয়। এর পর থেকে আরো অপ্রতিরোধ্য হতে থাকে ইভান।
ব্যবসায়ের নামে নির্যাতন ও মাদক ব্যবসা
পড়ালেখা শেষ না করেই এলাকায় ওয়াইফাই ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবসা শুরু করে সে। অভিযোগ রয়েছে ইভানের কারণে এলাকায় অন্য কোনো ব্রডব্যান্ড প্রতিষ্ঠান সংযোগ দিতে পারে না। সংযোগ দেওয়ার পর মারধর করে তার কেটে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে ইভানের বিরুদ্ধে। শুরুর দিকে ইভান শুধু ‘বড় ভাই ছোট ভাই’ নিয়ে এলাকায় মারপিট করলেও কোনো বাধা না পেয়ে একসময় ইয়াবা সহ সব ধরণের মাদক ব্যবসায়ের সাথে জড়িয়ে পড়ে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের মাধ্যমে ইন্টারনেট ও মাদক দুই ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকে সে।
সালামীর নামে চাঁদা আদায়
এলাকাবাসীর মাধ্যমে জানা যায়, মাদকের ব্যবসা আর ইন্টারনেট ব্যবসার সাথে ঈদ সহ অন্যান্য অনুষ্ঠানের সময় এলাকার সব দোকান থেকে চাঁদা তুলে সে। আর এর সর্বনি¤œ পরিমাণ হয় ১হাজার টাকা। যদি কেউ এই টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও রাতের আধারে দোকান ভাঙচুর করে সে। আর বরাবরের মতই এসব কাজে সাহায্য করতো উঠতি বয়সী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।
এলাকাবাসী জানান, প্রত্যেক ঈদে ও সবেবরাতের রাতে এলাকার সব দোকানে কার্ড দিয়ে আসতো। এলাকা সাজানো ও ঈদে ‘ডিজে পার্টি’ নাম করে আমাদের কাছে সালামী চাইতো। সেই টাকা দিয়ে নেশা করতো আর সাউন্ডবক্স ভাড়া করে এনে গানবাজনা করত। আর যে এসবে বাধা দিতো তাকেই অকথ্য ভাষায় গালাগালি আর মারপিট করতো।
আপনার মতামত লিখুন :