নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে একসময় আলোচিত এক নাম ছিল মোহাম্মদ আলী। কেউ তাকে বলতো কিং মেকার, আবার কেউ বলতো পীর সাহেব। আওয়ামী লীগের শাসনামলের ১৬ বছর তিনি ওসমান পরিবারের সাথে সখ্যতা রেখে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখে ছিলেন। কিন্তু ছাত্র-জনতা গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নারায়ণগঞ্জ থেকে ওসমান পরিবারের সদস্যরা পালিয়ে গেলে তিনি অনেকটা বেকায়দায় পড়েন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নারায়ণগঞ্জ জেলা ইউনিট কমান্ডের সাবেক কমান্ডার। ফ্যাাসিস্ট সরকার পতনের পর গত ২৪ মার্চ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে একটি অনুষ্ঠানে নিজের বক্তব্যের পর জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে বসেন। তখন বিষয়টি অনেকেই ভালোভাবে নেননি। এ ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ খান টিপু। তিনি মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে রীতিমত আন্দোলন শুরু করেন। মোহাম্মদ আলীকে প্রশাসনের কোন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রন না জানানোর জন্য। এমন কি আবু আল ইউসুফ খান টিপু মোহাম্মদ আলীকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সহ মুক্তিযুদ্ধের পর ব্যাংক ডাকাতি করেছে বলে মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেন।
এমন পরিস্থিতিতে নিজের ভুল স্বীকার করে ২৫ মার্চ গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়ে দু:খ প্রকাশ করেন সাবেক এই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। এরপর থেকে নারায়ণগঞ্জের কোথাও কোন আলোচনায় ছিলেন না মোহাম্মদ আলী।
তবে এবার আবারো তিনি আলোচনায় উঠে এসেছেন। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন তিনি বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এর সভাপতি প্রার্থী ঘোষণার মধ্য দিয়ে।
গত ২৩ জুলাই পুরান ঢাকার লালবাগের সাগুন কমিউনিটি সেন্টারে দিবি সদস্যদের এক সমাবেশে সভাপতি পদে নির্বাচন করবেন বলে ঘোষণা দেন। এ সময় তিনি বলেন, এফবিসিসিআই আপনাদের। এখানকার সবকিছুতে আপনাদের অধিকার রয়েছে। আমি সভাপতি নির্বাচিত হলে আপনাদের অভীতের মত যেকোনো গ্রহণযোগ্য সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেব। এসএমই উদ্যোক্তাদের সমস্যা, ভ্যাট, কম সুদে ব্যাংক ঋণ এগুলো অবশ্যই সমাধান হবে।
অনুষ্ঠানে কামাল উদ্দিন আহমেদ মো. হেলাল উদ্দিন, আব্দুল ওয়াহেদ, মো. আব্দুস সালাম শফিকুল ইসলাম ভরসা সহ অন্তত ৪০ জন এফবিসিসিআই নেভা উপস্থিত ছিলেন। প্রায় ৭০০ ব্যবসায়ী প্রতিনিধি উপস্থিত হন।
এর আগে ১২ জুলাই নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ীদের নিয়ে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে এ সংক্রান্ত একটি আলোচনা সভা করেছিলেন মোহাম্মদ আলী। ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন মো. হেলাল উদ্দিন, আব্দুল ওয়াহেদ, খন্দকার রুহুল আমিন, প্রবীর কুমার সাহা, শফিকুল ইসলাম ভরসা নিয়াজ আলী চিশতী, এম এ সাত্তার খান, হাফেজ হারুন, আমজাদ হোসেন, মাহবুব ইসলাম রুনু, কাউসার আহমেদ, আলাউদ্দিন মালিক, ফজলুর রহমান, পরিতোষ কান্তি সাহা, মাহফুজুর রহমান খান, আলী জামান এমবিএ, শাকিল আহমেদ, আওলাদ হোসেন রাজিব, আলমগীর হোসেন, ট্রফি ইসলাম, আব্দুল হালিম ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা।
এফবিসিসিআই এর সভাপতি পদে প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে জাতীয় একটি গণমাধ্যমকে মোহাম্মদ আলী জানিয়েছেন, এফবিসিসিআই কেবল ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি সংগঠন নয়, এটি আমাদের অর্থনৈতিক রূপান্তরের অন্যতম চালিকাশক্তি। আমি বিশ্বাস করি, ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষা ও দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এফবিসিসিআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবেন। সভাপতিপদে নির্বাচিত হলে আমি এ সংগঠনকে আরও কার্যকর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলতে কাজ করব। এছাড়া এই সংগঠনকে আধুনিক, ডিজিটাল, দায়বদ্ধ ও সক্রিয় অংশীদারে পরিণত করতে চাই।
তিনি আরও জানান, দেশের শিল্প ও ব্যবসায়ীক পরিবেশকে টেকসই ও আধুনিক করতে নীতি সহায়তা, তরুণ উদ্যোক্তা বিকাশ এবং আঞ্চলিক ব্যবসা সম্প্রসারণকে অগ্রাধিকার দেবেন। তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ বাজারে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, তা মোকাবিলায় সমন্বিত ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের প্রয়োজন। আমি একটি ব্যবসাবান্ধব নীতি কাঠামো গড়ে তোলা, তরুণ উদ্যোক্তাদের পৃষ্ঠপোষকতা, এসএমই খাতের বিকাশ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান দৃঢ় করার লক্ষ্যে কাজ করতে চাই।
নিজেকে এফবিসিসিআই এর সভাপতি হিসেবে প্রার্থী ঘোষণার মধ্য দিয়ে আবারো আলোচনায় উঠে এসেছেন এই কিং মেকার। তবে তার এ ঘোষণার পর পরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের আইডিতে মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধাচারণ শুরু করেছেন মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ খান টিপু। তিনি নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক এমপি আরেক ব্যবসায়ী নেতা সেলিম ওসমানকে নিয়ে মোহাম্মদ আলীর দেওয়া বক্তব্য শেয়ার করে মোহাম্মাদ আলীকে বহুরূপী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
উল্লেখ্য এর আগে ১/১১ এর পূর্ববর্তী সময়ে মোহাম্মদ আলী এফবিসিসিআই এর সিনিয়র সহ সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই সাথে তিনি ভারত বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এক সময়ে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ছিলেন মোহাম্মদ আলী। অনেকেই তাকে ডাকেন কিং মেকার হিসেবে। পর্দার আড়ালের এ সুদর্শন ব্যক্তি ছিলেন অনেক কিছুর কেন্দ্রবিন্দু। নারায়ণগঞ্জে সর্বদলীয় রাজনৈতিক দলে তাঁর অবস্থান ছিল শক্ত। কিন্তু এখন হারিয়ে গেছে তাঁর সেই স্বকীয়তা। ক্রমশ আর আগের মত লোকারণ্য হয় তার দরবার। আগের মত ঢু মারেন না রাজনীতিকেরা যাঁরা নিয়মিত তাঁর কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে চলতেন। সামগ্রিক দিক দিয়ে মোহাম্মদ আলীর সেই কারিশমাটিক অবস্থা আর নাই সেটাও প্রতীয়মান।
২০১৬ সালের সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের পর ২০১৭ সালের জুলাইতে বাজেট অনুষ্ঠানে আচমকা নগর ভবনে হাজির হন মোহাম্মদ আলী। সঙ্গে ছিলেন এমপি সেলিম ওসমান। বদলে যায় দৃশ্যপট। তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত হয় নিতাইগঞ্জ থেকে ট্রাক স্ট্যান্ড সরে যাবে। সরেও যায়। কিছুটা বিশৃঙ্খলা কমে আসে সেখানকার। কার্যত সেটাই ছিল মোহাম্মদ আলীর সবশেষ চনমক।
মোহাম্মদ আলী এক সময়ে বিএনপির সদস্য ছিলেন। তিনি দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সহসভাপতি, ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে নির্বাচনে তিনি নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা-সিদ্ধরগঞ্জ) আসন থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
জানা যায়, ২০১৪ সালের ২৬ জুন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের উপনির্বাচনে ওসমান পরিবারের সদস্য সেলিম ওসমানের পক্ষে সরাসরি মাঠে নামেন মোহাম্মদ আলী এবং বিএনপির ভোটারদের ও নেতাকর্মীদেরকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে তিনি আওয়ামীলীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে বিএনপির এই সাবেক সাংসদ কাজ করে গেছেন। একই সাথে বিপুল ভোটের ব্যবধানে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন সেলিম ওসমান।
পরর্বীতের ২০১৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মোহাম্মদ আলী ফের আলোচনায় আসেন। কারণ ক্লাবের বর্তমান সভাপতি ও ভোটে নির্বাচিত সভাপতি প্রার্থী তানভীর আহমেদ টিটু এমপি শামীম ওসমানের শ্যালক। তাঁর পক্ষে কাজ করেন সেলিম ওসমান ও শামীম ওসমান। তবে এ দুইভাইকে এবার অনেকটাই ব্যাকফুটে রেখে সামনে ও আড়ালে থেকে পুরো কারিশমা দেখান মোহাম্মদ আলী। সরাসরি মাঠে নামেন টিটুর পক্ষে। বিনিময়ে জিতেছেন তিনি নিজে।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ওসমান পরিবারের দুই সদস্য যথাক্রমে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে শামীম ওসমান ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের পক্ষে মাঠে নামেন মোহাম্মদ আলী। অনেকটা আড়ালে থেকেই ওসমান পরিবারের এই দুই সংসদকে জয়ী করার পক্ষে কাজ করেন তিনি। কখনও কখনও প্রত্যক্ষভাবেও কাজ করেছেন। ফলশ্রুতিতে বিপুল ভোটের ব্যাবধানে জয়ী হয় তাদের।
নারায়ণগঞ্জে বিগত দিনে অনেক রাজনীতিকের উত্থান এ মোহাম্মদ আলীর হাত ধরে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআই এর নির্বাচনেও কুশীলব হিসেবে কাজ করেন তিনি। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারীর বিতর্কিত নির্বাচনেও তিনি ছিলেন এমপি। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে ভোটের মাত্র ১৭ দিনে আগে গিয়াসউদ্দিনকে বিএনপিতে জয়েন করিয়ে মনোনয়ন নিশ্চিত করে আলোচনার চূড়ায় উঠেন মোহাম্মদ আলী।
আপনার মতামত লিখুন :