আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পুনর্বাসন, কমিটি বাণিজ্য, ত্যাগী নেতাদের কমিটিতে মূল্যায়ন না করাসহ একের পর এক অভিযোগ উঠছে জেলা কৃষকদলের বর্তমান নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে। একই সাথে গত কয়েকদিন ধরে জেলা কৃষকদলের দুটি গ্রুপ পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি, সংবাদ সম্মেলন করে একে অপরকে তুলোধুনো করছেন, আখ্যা দিচ্ছেন ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ নামে যা নিয়ে বিপাকে পড়েছে বিএনপির নেতৃবৃন্দ। প্রতিনিয়ত এই দ্বন্ধ প্রকট আকার ধারণ করছে। এই অন্তকোন্দল কোথায় গিয়ে গড়াবে তা তারা নিজেরাও জানেন।
তবে কৃষকদলের বড় একটি গ্রুপই এই অন্তকোন্দলনের জন্য জেলা কৃষকদলের বর্তমান আহবায়ক ডা. শাহীন মিয়াকে দুষছেন। তিনি ও সদস্য সচিব আলম মিয়ার নেতৃত্বে জেলা কৃষকদল আসার পর থেকেই দুটি গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছেই। এর আগের জেলা কৃষকদলের কমিটি নিয়েও নানা সমালোচনা থাকলেও এবারের কমিটি অল্পদিনেই অনেক বিতর্ক কুড়িয়েছে। এই বিতর্কের মধ্যেই গত ২৩ এপ্রিল দলীয় নীতি, আদর্শ ও শৃঙ্খলা পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে জেলা কৃষকদলের সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক হাজী দেওয়ান মাহমুদ ও যুগ্ম আহবায়ক মোহাম্মদ আলীকে প্রাথমিক সদস্য পদসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
২৫ মার্চ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কৃষকদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি কৃষিবিদ হাসান জাফির তুহিন এবং সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ডা. মো. শাহীন মিয়াকে আহবায়ক, মো. আলম মিয়াকে সদস্য সচিব এবং হাজী দেওয়ান মাহমুদকে সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক করে ৭৯ সদস্যবিশিষ্ট জেলা কমিটির অনুমোদন দেয়।
এ কমিটিতে এই দুজন পদ পেয়েছিলেন। বহিষ্কৃত ২ নেতার বিরুদ্ধে আওয়ামীলীগ নেতা সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সম্পর্ক রয়েছে। কমিটি ঘোষণার পরপর তাদের দুইজনের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দলের ভিতরে নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তারা এই দুই নেতার বহিষ্কারের দাবি তোলে। এর মধ্যে জেলা কৃষকদলের সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক হাজী দেওয়ান মাহমুদ ফতুল্লা থানায় করা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মাবরুর হোসাইন হত্যা মামলার ২৫ নম্বর আসামি। গত ২১ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে ফতুল্লা থানায় এ হত্যা মামলা করা হয়।
কৃষকদলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, আড়াইহাজার, রূপগঞ্জ, ফতুল্লাসহ বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নেতাকর্মীদের দলে ভিড়িয়েছেন বর্তমান আহবায়ক ডা. শাহীন মিয়া। আড়াইহাজারের সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম বাবু, রূপগঞ্জের সাবেক এমপি ও মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী ও সোনারগাঁয়ে জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি লিয়াকত হোসেন খোকার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত বেশ কয়েকজন নেতা জেলা কৃষকদলের কমিটিতে দায়িত্ব পেয়েছেন এই শাহীনের আশির্বাদে। তারাব পৌরসভা কৃষকদলের সাধারণ সম্পাদক মোঃ বাদল ভূঁইয়া, রূপগঞ্জ থানা কৃষকদলের সহ সাধারণ সম্পাদক মোঃ মোজাম্মেল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন। পাঁচ আগষ্টের পর জেলা কৃষকদলের আহবায়ক কমিটি ঘোষণার পর কৃষকদলে পুনর্বাসিত হন এই দুই নেতা।
এছাড়াও জেলা কৃষকদলের যুগ্ম আহবায়ক আলী হোসেন, রূপগঞ্জ থানা কৃষকদলের সহ সভাপতি আসাদুল্লাহ, রূপগঞ্জ থানা কৃষকদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ উজ্জ্বল মিয়া দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের স্থানীয় এমপি গাজীর সাথে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার অভিযোগ রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গাজীর সাথে তাদের একাধিক ছবি ও তাদের নাম প্রচারিত আওয়ামী লীগের পোস্টারের ছবি ভাইরাল হয়েছে। এছাড়াও পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে জেলা কৃষকদলের যুগ্ম আহবায়ক পদ কেনার অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগ নেতা আলী আহমেদের বিরুদ্ধে। বর্তমানে তিনি জেলা কৃষকদলের যুগ্ম আহবায়ক পদে আছেন। এছাড়াও সোনারগাঁ থানা কৃষকদলের সভাপতি হওয়ার জন্য নিয়মিত তদবির চালাচ্ছেন এই নেতা।
নেতাকর্মীদের অভিযোগ, নারায়ণগঞ্জের সাবেক এমপি শামীম ওসমানের অনুসারী ও প্রধান সহযোগী, মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পরিচিত মোঃ আল আমিন ইকবালকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ কৃষকদলের যুগ্ম আহবায়ক পদে দায়িত্ব পেয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ জেলা কৃষকদলের কমিটিতেও আছেন এই ইকবাল। আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় না থেকেও ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর দক্ষিণের যুগ্ম আহবায়ক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় আল আমিন ইকবালকে। সর্বশেষ ২০২৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা কৃষকদলের আহবায়ক কমিটিতে দ্বিতীয় যুগ্ম আহবায়কের দায়িত্ব পান ইকবাল। অর্থের জোরেই আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও আঁতাত করে চলার পরেও কৃষকদলে পুনর্বাসিত হতে পেরেছেন এই ইকবাল। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার বক্তাবলী ইউনিয়নের বাসিন্দা ইকবাল। এলাকাটি নারায়ণগঞ্জের সাবেক এমপি শামীম ওসমানের নির্বাচনী এলাকার আওতাধীন। সেই সুবাদের শামীম ওসমানের অনুসারীদের মাধ্যমে ওসমান পরিবারের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে নিজের ব্যবসা বাণিজ্য চালিয়ে যান ইকবাল। মূলত সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ে তার ব্যবসা রয়েছে। সেই টাকা দিয়েই পাঁচ আগষ্টের পর বিএনপির রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ার চেষ্টা করছেন ইকবাল। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ইদানিং সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি।
ডা. শাহীন মিয়ার এইসব কর্মকান্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে তার ও সদস্য সচিব আলম মিয়ার বিরুদ্ধে একাধিক কর্মসূচি পালন করেছে পদবঞ্চিতরা। গত ৩রা মে নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সামনে জেলা কৃষকদলের ব্যানারে আয়োজিত এক প্রতিবাদ সমাবেশে জেলা কৃষকদলের সাবেক যুগ্ম আহবায়ক নজরুল ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগের সময় আমরা তিলে তিলে কৃষকদলকে শক্তিশালী করে তুলি। কিন্তু সবশেষ জেলা কৃষকদলের কমিটি ডা.শাহিন মিয়া এবং আলমের নেতৃত্বে গঠিত হলে প্রচুর কমিটি বাণিজ্য শুরু হয়। এই ডা. শাহিন একজন ভুয়া ডাক্তার। তার কোনো ডাক্তারের সার্টিফিকেট নেই। তিনি টাকার বিনিময়ে তড়িঘড়ি করে পূর্ণাঙ্গ আহবায়ক কমিটি গঠন করেন। যার প্রমাণ এরই মধ্যে সবাই পেয়েছে। তাই আমরা এক সংবাদ সম্মেলন করে এই কমিটি বিলুপ্ত করার দাবি জানাই। আমি কোনো পদলোভী ব্যক্তি নই। আমি নিজের জন্য না, আমি চাই দলের নেতৃত্বে সৎ ও যোগ্য লোক আসুক। এর আগে নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে পদবঞ্চিতদের দোষারোপ করে জেলা কৃষকদলের আহবায়ক ডা. শাহীন মিয়া বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসররা’ কৃষক দলের কমিটিতে বিশৃঙ্খলা করছে। তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে তাদের প্রতিহত করারও ঘোষণা দেন বিএনপির সহযোগী সংগঠনটির এ নেতা।
এর আগে ডা. শাহীন মিয়া ও কায়সার রিফাতের নেতৃত্বাধীন জেলা কৃষকদল নিয়েও বিতর্কের শেষ ছিল না। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাদের বিরুদ্ধে আদমজী ইপিজেডের মালামাল লুট এবং ছিনতাইয়ের অভিযোগ উঠে। এসব ঘটনার ফলস্বরূপ পরবর্তীতে কেন্দ্র থেকে জেলা কৃষকদলের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়।
জানা যায়, গত ১৪ অক্টোবর ছিনতাইয়ের অভিযোগে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা কৃষকদলের সাবেক চার নেতাকর্মী র্যাবের হাতে গ্রেফতার হোন। আর গত ২৯ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৪টায় আদমজী ইপিজেড থেকে বের হওয়া মালামাল লুটের অভিযোগ উঠে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা কৃষকদলের নামধারী কয়েকজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। পরে এ ঘটনায় গত ২ অক্টোবর রাতে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় সাধারণ ডায়েরী (জিডি) করেন মহানগর মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের সাবেক নারী কাউন্সিলর আয়েশা আক্তার দিনা। তবে এ জিডির রেশ কাটতে না কাটতেই গত ৮ অক্টোবর যুবদল নেতা শাহেদ আহমেদ, স্বেচ্ছাসেবকদল নেতা মমিনুর রহমান বাবু, সাবেক কাউন্সিলর দিনা এবং স্থানীয় একটি অনলাইনের সম্পাদক শহীদুল্লাহ রাসেলের নাম উল্লেখ করে মানহানি মামলার আবেদন করেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা কৃষক দলের তৎকালীন আহবায়ক মো. তৈয়ম।
আপনার মতামত লিখুন :