গত ১৩ এপ্রিল কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে নারায়ণগঞ্জে ফিরে এসেছেন সাবেক ছাত্রদল নেতা জাকির খান। এরপর থেকে নারায়ণগঞ্জে বিএনপির রাজনীতিতে জাকির খান একটি আলোচিত নাম। বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন, সহ বিএনপির সহযোগী সংগঠনের নেতারা ছুটছে জাকির খানের দরবারে। তাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে শেয়ার করে নিজেদের জাকির খানের অনুসারি প্রমাণে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন নেতারা। কেউ কেউ জাকির খান নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক এমপি ওসমানের দ্বারা নির্বাসিত এবং তার বিপরীত শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টাও চালিয়েছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষিত ৩১ দফা দাবি বাস্তবায়নে জাকির খান ভূমিকা রাখবে বলেও মন্তব্য করে অনেকে সমালোচিত হয়েছেন। তবে এসব ঘটনার পূর্বে সাবেক এমপি শামীম ওসমান এবং জাকির খানের মধ্যে অন্তরালে রাজনৈতিক অনেক কূটচালের আভাস পাওয়া গিয়ে ছিলো। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে সেই কূটচাল আর সফল হয়ে উঠেনি।
একাধিক বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালে জাকির খান র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক এমপি শামীম ওসমান জাকির খানকে দলে বেড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। জাকির খানের প্রশংসা করে প্রকাশ্যে বেশ কয়েকবার শামীম ওসমানকে বক্তব্য দিতেও দেখা গেছে। যে সকল বক্তব্য এখন এসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে। ওই বক্তব্যে শামীম ওসমানকে বলতে শোনা গেছে, দেওভোগে একটি ছেলে ছিল, তার নাম জাকির হোসেন, সবাই তাকে জাকির খান বলে। ভাল ছেলে ছিল, বেয়াদব ছিলনা। কিন্তু তাকে বিএনপিতে এনে সন্ত্রাসী বানানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯৮৯ সালে শামীম ওসমানের বড় ভাই প্রয়াত নাসিম ওসমানের হাতে ধরে জাতীয় পার্টির ছাত্রসমাজে যোগ দিয়ে নারায়ণগঞ্জের ছাত্র রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন। ১৯৯১ সালে জাকির খানের সঙ্গে নাসিম ওসমানের বিরোধ বাধে। পরে জাকির খান বিএনপি নেতা কামালউদ্দিন মৃধার নেতৃত্বে ১৯৯৪ সালে বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৯৫ সালে দেওভোগ এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী দয়াল মাসুদকে শহরের সোনার বাংলা মার্কেটের পেছনে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে দুর্ধর্ষ হিসেবে শহরে পরিচিত পান জাকির খান।
জাকির খানকে নিয়ে শামীম ওসামনের দেওয়া এমন বক্তব্যে প্রেক্ষিতে সে সময় অনেকেই বুঝতে পেরেছিলেন এবার জাকির খানকে রাজনীতিতে নিজের দলের ভিড়াতে চাইছেন শামীম ওসমান। যাতে করে দেওভোগ এলাকাতে তার নিজের কর্তৃত্ব গড়ে তুলতে পারে। পাশাপাশি তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বি সাবেক মেয়র আইভীকেও কোনঠাসা করতে পারে রাজনৈতিক ভাবে।
আওয়ামী লীগ দলীয় বেশ কিছু সূত্র থেকে জানা গিয়েছিলো জাকির খানের জামিনের ব্যাপারে সে সময় শামীম ওসমান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সুপারিশ করেছিলেন যাতে করে জাকির খানের জামিন হয় এবং তিনি জাকির খানকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়াবেন।
শামীম ওসমানের এমন দাবির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী জাকির খানের বিষয়ে খোঁজ খবরও নিয়েছিলেন বলে জানা গেছে। তবে শেষ পর্যন্ত শামীম ওসমান এই কুটচালে সফল হতে পারেনি। এর মধ্যে ছাত্র জনতার আন্দোলনে সব কিছু লন্ড ভন্ড হয়ে গেলে শেখ হাসিনা সহ শামীম ওসমান দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ৮ আগস্ট ড. মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়।
এর মধ্যে জাকির খানের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া সব মামলা থেকে তিনি খালাস পেয়ে গত ১৩ এপ্রিল মুক্তিলাভ করে।
মুক্তির পর জাকির খানের অনুসারীরা তাকে বিশাল শোডাউন দিয়ে নারায়ণগঞ্জে আনেন। এরপর থেকে মূলত বদলে যেতে শুরু করে প্রেক্ষাপট। জাকির খান মুক্তির পর তাকে নারায়ণগঞ্জের বিএনপির ভবিষ্যত কান্ডারি হিসেবেই উপস্থাপন করার চেষ্টা করছেন অনেকেই। তবে এই জাকির খানের পাশে এখন পর্যন্ত গুটি কয়েক সহযোগী সংগঠনের নেতা এবং পদত্যাগী ও বহিষ্কৃতদের বাদে জেলা ও মহানগর বিএনপির শীর্ষ কোনো নেতাকে দেখা যায়নি।
পাশাপাশি জাকির খানের মুক্তি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে ব্যাপক সমালোচনার ঝড়, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সেই সমালোচনার ঝড় দেশের বাইরে থেকেও আছড়ে পড়ছে। এমনকি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরার সাংবাদিক জুলিফিকার পর্যন্ত জাকির খানের সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একাধিক পোস্ট করেছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জাকির খান মূলত একজন আলোচিত সন্ত্রাসী। গত বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৩ সালে অপারেশন ক্লিন হার্টের সময় জাকির খান ছিলেন হিট লিস্টে। ক্রসফায়ারের ভয়ে দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে ছিলেন জাকির খান। সেই পলাতক জীবনকে এখন রাজনৈতিক নির্বাসন বলে প্রচার করতে চাইছেন তার অনুসারীরা। এখন দেখার বিষয় যে জাকির খানকে বিএনপি সন্ত্রাসের হিট লিস্টে রেখেছিলেন সেই জাকির খানকে বিএনপি এখন গ্রহণ করে সমালোচনা আরো তুঙ্গে নিয়ে যাবেন নাকি বিএনপি নিজেদের দলের ইমেজ ধরে রাখতে স্বচ্ছ ধারার রাজনীতি নারায়ণগঞ্জে অব্যাহত রাখেন।
আপনার মতামত লিখুন :