নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দাপিয়ে বেড়াতেন হাজী ইয়াছিন মিয়া। দলের প্রভাবে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল এই নেতার। সবশেষ অভ্যুত্থান ঘটার দিন সকাল পর্যন্ত দলের হাইকমান্ডের নির্দেশনায় সরব থেকে আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার উপর ঝাপিয়ে পড়েছিল তার সন্ত্রাসী বাহিনী। তবে, পরিবর্তিত দেশে তার আর আওয়ামী রাজনীতি করার আগ্রহ নেই বলে শুভাকাঙ্খীদের জানিয়েছেন।
২০০৩ সালে কাউন্সিলের মাধ্যমে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হোন হাজী ইয়াছিন মিয়া। এরপর হতে তার আর পিছু তাকাতে হয়নি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা আসার পর হতে ভাগ্য বদলে যায়। বিশাল এক বাহিনী গড়ে সর্ব সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল তিনি। দলের মূল ধারার নেতৃত্বে থাকার সুবাদে বিরোধিতা করার দুঃসাহস দেখানো মানুষদের ভুয়া-মিথ্যা মামলা-হামলায় জর্জরিত করে রাখতেন ইয়াছিন। তার অপকর্মের প্রতিবাদীরা নিজ দলের হলেও করা হতো নির্মম নির্যাতন।
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তি একেএম শামীম ওসমানের বিশ্বস্ত নেতা হিসেবে খ্যাতি রয়েছে ইয়াছিন মিয়ার। যার ফলে ৩ বছরের জন্যে অনুমোদন দেওয়া থানা কমিটির আর পরিবর্তন করা হয়নি। তৃনমূল আর ত্যাগী নেতাকর্মীদের মতে, সভাপতি মজিবুর আর সাধারণ সম্পাদক ইয়াছিনের প্রতি শামীম ওসমানের চরম আস্থা থাকায় জেলার অধিনস্থ অন্যান্য থানায় কাউন্সিল হলেও সিদ্ধিরগঞ্জে হয়নি। তবে ২০২২ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তার বসবাসরত ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী দেওয়া সত্বেও বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীর হয়ে নির্বাচন করায় ইয়াছিনের প্রতি চরম ক্ষিপ্ত হোন সাংসদ শামীম ওসমান। যার জের ধরে একপর্যায়ে দলের মধ্যে কোনঠাসায় পড়ে যান ইয়াছিন।
নারায়ণগঞ্জের পাষবিক এক ঘটনা 'সেভেন মার্ডার'। আওয়ামী লীগের সাবেক প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম (চেয়ারম্যান) ও আলোচিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুর হোসেনের আধিপত্যের দ্বন্দ্বে প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ ৭টি তাজা প্রাণ কেরে নেয় ঘাতক ন‚র হোসেন। এই হত্যাকান্ড সংঘটিত করায় সহযোগিতায় ছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও নুর হোসেনর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীও। সেই ঘটনার সঙ্গেও নিজের নাম লিখিয়েছিলেন ইয়াছিন। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি নুর হোসেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ফলে সাত খুনে আলোচনায় এসে মামলায় নাম আসে ইয়াছিনের। মামলার বিচারিক কার্যক্রমের একপর্যায়ে চার্জসিট থেকে নাম কাটা যায় ইয়াছিনের। এরপর আরও বেপরোয়া বনে যান তিনি।
নিজের ক্ষমতাবলের প্রভাব খাঁটিতে বিভিন্ন ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান,আদমজী ইপিজেডের কিছু সংখ্যক কারখানা, মিতালি মার্কেটসহ বহু সেক্টর নিয়ন্ত্রণে রেখে বিশাল অর্থবিত্তের মালিক বনে যান। তার সম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করেছেন নিজ ছোট্ট ভাই আবুলসহ একঝাঁক ক্যাডার বাহিনী।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে (নাসিক) ২ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও থানা বিএনপির বহিস্কৃত সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেনকে সাপোর্ট দেওয়ায় আ:লীগে বিতর্কিত হোন ইয়াছিন। তার সহযোগিতায় ইকবাল কাউন্সিলর হোন এমন অভিযোগ শামীম ওসমান প্যানেলে চড়াও রয়েছে। অভিযোগ আছে, ইয়াছিনের অর্থনৈতিক যোগানদাতা ইকবাল হোসেন।
এদিকে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার যৌক্তিক আন্দোলনকে প্রতিহত করতে মারিয়া হয়ে দমনে নেমেছিল ইয়াছিনসহ তার বাহিনীর সদস্যরা। দেখা গিয়েছিল, বিভীষিকাময় সময়কালে শামীম ওসমানের নির্দেশনায় সিদ্ধিরগঞ্জ অঞ্চলে বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিরস্ত্র জনতার উপর ঝাপিয়ে পড়তে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন এই নেতা। তবে,৫ আগস্ট অভ্যুত্থান ঘটলে আত্মগোপনে চলে যান ইয়াছিন মিয়া। সুত্রমতে তিনি এখন ঢাকায় তার মেয়ের বাড়িতে অবস্থান করছেন। এদিকে স্বৈরাচার সরকার পতনের পর থেকে বৈষম্যবিরোধী হত্যা ও হত্যা চেষ্টায় ইয়াছিনের বিরুদ্ধে ৩০টির বেশি মামলা রুজু হয়েছে। বর্তমানে বৃদ্ধ বয়সে গ্রেফতার আতঙ্কে দিন কাটছে তার।
তৃনমুল কয়েকজন আ:লীগ নেতাকর্মীদের ভাষ্য, আওয়ামী লীগের ব্যানারে দু'হাতে অর্থ কামানো ইয়াছিন সরকার পতনের পর হতে একটি ইসলামী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর প্রচেষ্টায় আছেন। নিজের মেয়ের শ্বশুর বাড়ির স্বজনদের মাধ্যমে এই চেষ্টা অব্যাহত আছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইয়াছিন মিয়ার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ কর্মী বলেছেন, ইয়াছিন মিয়া এখন নিজের মেয়ের বাড়িতে বসবাস করছেন। দলীয় নেতাকর্মীদের একাংশের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রাখলেও আগামীতে রাজনীতি না করার সিদ্ধান্তের ভাবনায় আছেন।
ইয়াছিন মিয়া তার ঘনিষ্ঠদের জানান, সরকার পতনের পর হতে তার অসুস্থতা আরও বেড়েছে। বৃদ্ধ বয়সে তার স্ত্রী-সন্তানদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে আর আওয়ামী লীগের রাজনীতি করবেন না। তার মেয়েরা তাকে রাজনীতি করতে নিষেধ করেছেন।
রাজনীতি ছাড়ার সত্যতা জানতে ইয়াছিন মিয়ার মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা হলে তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
আপনার মতামত লিখুন :