নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী নূর হোসেন কারাগারে থেকেও হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র করছেন অভিযোগ তোলা হয়েছে। তিনি কারাগারে থেকেও বিভিন্নজনের কাছে টাকা তুলে দিচ্ছেন। এর আগে নূর হোসেনের প্রভাব পুনরায় সিদ্ধিরগঞ্জে কায়েম করতে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগের অভিযোগ পাওয়া যায়।
১০ জুলাই সিদ্ধিরগঞ্জে বিএনপির এক সমাবেশে জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটির সদস্য ও সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দিন বলেন, আপনারা জানেন শেখ হাসিনার আমলে অনেক গডফাদার অনেক সন্ত্রাসী তৈরি হয়েছে। তেমনি এক গডফাদার তৈরি হয়েছিল আমাদের নারায়ণগঞ্জে। তিনি সন্ত্রাসীদের স্বর্গ রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিল। গডফাদারের এক বিশিষ্ট সন্ত্রাসী ছিল এই শিমরাইল এলাকায় ৭ খুন করেছে। এই খুনের কারণে নারায়ণগঞ্জকে সিদ্ধিরগঞ্জকে চিনেছে সারা বাংলাদেশের মানুষ। ঘৃণা লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁটে করে ফেলেছে। জুয়া, মদ ইত্যাদি নেশা সামগ্রী বিক্রি করে উঠতি বয়সের ছাত্র সমাজের চরিত্রকে সেদিন ধ্বংস করে দিয়েছিল, বিভিন্নভাবে অন্যায় অত্যাচার করেছে মানুষকে। সেদিন মানুষ তার সামনে গিয়ে কথা বলতে পারে নাই তাকে বাধা দিতে পারে নাই । এরকম এক সন্ত্রাসী ছিল এবং এই সন্ত্রাসী একটি গরিব ঘরের সন্তান হয়ে কোটি কোটি টাকা অর্থ সম্পদ করেছে ভাই আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে। তারা ফুল দিয়ে একটি ঢিল দিতে পারে নাই তাদেরকে তাদের অপকর্ম অপকর্মের কারণে আল্লাহর তরফ থেকে গজব নেমে এসেছে। তারা আজকে কোথায় বন্দী খাঁচায় জেলখানায়। জেলখানায় থেকেও আজকে তারা অপকর্ম ও লুণ্ঠন করে সম্পদ সংগ্রহ করে তাদের হাতে তুলে দেয়। সেখানে থেকে তারা ষড়যন্ত্র করে কিভাবে এই এলাকায় হত্যাকান্ড করবে।
তিনি বলেন, গত ১৬ বছর ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা জবরদখল করে দেশ শাসন করেছে। দেশের প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনা ধ্বংস করে দিয়েছে তাদের স্বার্থে। দেশের অর্থসম্পদ লুণ্ঠন করে চুরি করে ডাকাতি করে বিদেশে পাচার করে দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। অনেক আন্দোলন সংগ্রাম আমরা করেছি এই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। আমরা কারো প্রতি হিংসাপরায়ন নয়। সেজন্য তাদের ঘরগুলো- এখনো যে জায়গায় ছিল সে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। অন্য জায়গায় সেগুলো মাটির সাথে মিশে গেছে। আমি গিয়াসউদ্দিন বলতে পারি, আমি কখনো প্রতিহিংসার রাজনীতি করি না।
প্রসঙ্গত ২০২২ সালের ১৬ জানুয়ারীর নাসিক নির্বাচনের আগে দুটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ভাই-ভাতিজাকে জেতাতে কারাগারের কনডেম সেলে বসেই মোবাইল ফোনে এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠদের ফোন দেন নূর হোসেন। ফোনে তিনি বলেন, ‘শোনেন, আপনারা আমার ভাই নূর উদ্দিনকে পাস করান। টাকা-পয়সা যা লাগে নেন, কিন্তু নূর উদ্দিনকে পাস করান। যদি না করান তাইলে আমি ২০২৩ সালে জেল থেকে মুক্তি পাইতাছি। তখন কিন্তু কাউরে ছাড়ুম না। যা করার করমু।’
এর আগে ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল এ নির্মম ঘটনা ঘটে। সেদিন নারায়ণগঞ্জের একটি আদালতে হাজিরা শেষে প্রাইভেটকারযোগে ফিরছিলেন নাসিকের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন ও গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম। একইসময়ে আদালতের কার্যক্রম শেষে অপর একটি প্রাইভেটকারে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তাঁর গাড়িচালক ইব্রাহীম। পথিমধ্যে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে সাদা পোশাক পরিহিত র্যাব সদস্যরা তাদের ৭ জনকেই অপহরণ করে। ৭ জনকে অপহরণের ঘটনায় উত্তাল হয়ে উঠে নারায়ণগঞ্জ। দফায় দফায় চলতে থাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড অবরোধ। পরে ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীর চর ধলেশ্বরী এলাকা থেকে ছয়জনের ও ১ মে একজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ৭ জনকে হত্যাকান্ডের ঘটনায় একই পন্থা ও কায়দা অবলম্বন করা হয়। নিহতদের মধ্যে সবাইকে একই স্টাইলে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়া হয়। যাতে করে লাশ ভেসে উঠতে না পারে। উদ্ধার করা লাশের সবারই হাত-পা বাঁধা ছিল, পেটে ছিল ফাঁড়া। ১২টি করে ইট ভর্তি সিমেন্টের বস্তার দুটি বস্তা বেঁধে দেয়া হয় প্রতিটি লাশের সঙ্গে। তাদের সবার লাশের মুখ ছিলো ডাবল পলিথিন দিয়ে মোড়ানো। মামলা চলাকালে প্রধান আসামীকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা, আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আসামীদের চোখ রাঙানি, নরঘাতকদের পক্ষে আদালতপাড়ায় শোডাউনসহ নানা ঘটনায় গেল আলোচিত ছিল ৭ খুনের মামলাটি। তদন্ত শেষে প্রায় এক বছর পর ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল নূর হোসেন, র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় ডিবি পুলিশ। ওই বছরের ১৩ নভেম্বর নূর হোসেনকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা হয়। ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রæয়ারি দু’টি মামলায় নূর হোসেনসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। দু’টি মামলাতেই অভিন্ন সাক্ষী হলো ১২৭ জন করে। যার মধ্যে দু’টি মামলার বাদি, দু’জন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও প্রত্যক্ষদর্শীসহ ১০৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়। ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারী সকাল ১০টা ৪মিনিট থেকে ১০টা ৯ মিনিট পর্যন্ত তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন আলোচিত ৭ খুন মামলার রায় ঘোষণা করেন। নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলার প্রধান আসামী নাসিকের বরখাস্তকৃত কাউন্সিলর নূর হোসেন, র্যাবের চাকুরীচ্যুত অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব:) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, উপ অধিনায়ক মেজর (অব:) আরিফ হোসেন ও ক্যাম্প ইনচার্জ লে. কমান্ডার (অব:) এম এম রানাসহ ২৬ জনের ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। বাকি ৯ জনের মধ্যে অপহরণ ও লাশ গুমের সঙ্গে জড়িত থাকায় এক আসামীকে ১৭ বছর, অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকায় ৬ জনকে ১০ বছর এবং লাশ গুমে জড়িত থাকায় ২ জনকে ৭ বছরের কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত। পরবর্তীতে ২০১৭ সালেল ২২ আগস্ট সাত খুন মামলায় সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন, র্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেনসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। বাকি ১১ জনের মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
সাত খুন ছাড়াও নূর হোসেনের ঘাড়ে আরো কয়েকটি দুর্নীতি মামলার খড়গ রয়েছে। ২৩ বছর আগের একটি দুর্নীতি মামলায় এবার তিনি ফেঁসে যাচ্ছেন। দুদকের মামলায় ৪০৯/৪২০ ও দুর্নীতি দমন প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারার মামলায় নুর হোসেন আদালতে হাজির হয়েছিলেন। এটা পুরানো মামলা। এই মামলায় নুর হোসেনকে খালাস দেয়া হয়েছিল। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে মামলাটি পুনউজ্জীবীত করে চার্জের জন্য শুনানীর দিন নির্ধারণ করা হয়েছিল।
আপনার মতামত লিখুন :