নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের রাজনীতিতে এখন নতুন সমীকরণ। সোনারগাঁয়ের সঙ্গে সিদ্ধিরগঞ্জ যুক্ত হওয়ার পর থেকে এই আসনকে ঘিরে প্রতিদিন নতুন নতুন আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে বিএনপির ভেতরে এমপি প্রার্থী হওয়ার দৌড় এখন তুঙ্গে। কে হবেন হেভিওয়েট প্রার্থী এবং শেষ পর্যন্ত কে মাঠে টিকে থাকবেন, সেটিই এখন রাজনৈতিক মহলের বড় প্রশ্ন।
একাধিক নেতাকর্মী সূত্রে জানা গেছে, মাত্র চার দিন আগে ঢাকার বনানীর একটি রেস্টুরেন্টে গোপন বৈঠকে বসেছিলেন সোনারগাঁয়ের বিএনপি থেকে এমপি হতে ইচ্ছুক প্রায় সব প্রার্থী। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপির সভাপতি আজহারুল ইসলাম মান্নান। তবে অন্য সব প্রার্থী সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
এই বৈঠকে মূলত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কৌশল নির্ধারণ এবং প্রার্থী হিসেবে নিজেদের অবস্থান শক্ত করার বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক প্রার্থীর ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, আলোচনার মূল ফোকাস ছিল কীভাবে মান্নানকে ঠেকানো যায়। বৈঠকে উপস্থিত প্রায় সবাই একমত হন যে, মান্নানের জনপ্রিয়তা ও প্রভাবকে ভেঙে দিতে হলে সম্মিলিতভাবে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে।
আজহারুল ইসলাম মান্নান এতদিন সোনারগাঁ কেন্দ্রিক রাজনীতিতে ছিলেন একক প্রভাবশালী। দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় সংগঠন, আন্দোলন-সংগ্রাম এবং তৃণমূলের মধ্যে তার একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু নতুন সীমানায় সিদ্ধিরগঞ্জ যুক্ত হওয়ায় তার সেই প্রভাব অনেকটা সীমিত হয়ে গেছে। সিদ্ধিরগঞ্জে তার কার্যত কোনো সাংগঠনিক যোগাযোগ নেই। নতুন করে সেখানে মাঠ গড়ে তোলা তার জন্য সময়সাপেক্ষ ও কষ্টকর হয়ে উঠবে।
অন্যদিকে, সিদ্ধিরগঞ্জে বহু বছর ধরে মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিনের একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে। তিনি শুধু স্থানীয় রাজনীতিতেই নয়, সাংগঠনিক কার্যক্রমেও সিদ্ধিরগঞ্জকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। ফলে নতুন আসনে গিয়াস অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে চলে এসেছেন।
রাজনৈতিক মহলে আগে থেকেই ধারণা ছিল, সোনারগাঁয়ের সঙ্গে সিদ্ধিরগঞ্জ যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তখন থেকেই গিয়াস উদ্দিন সোনারগাঁয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। শুরুতে বিষয়টি নিয়ে অনেকে হাসাহাসি করলেও এখন মনে হচ্ছে গিয়াস অনেক আগেই রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দেখিয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি শুধু সিদ্ধিরগঞ্জেই নয়, সোনারগাঁওয়েও শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছেন। তার সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে সোনারগাঁয়ের মান্নান-বিরোধী নেতাদের সমর্থন। বিশেষ করে সাবেক এমপি রেজাউল করিম ও তার অনুসারীরা প্রকাশ্যে গিয়াসকে সমর্থন দিচ্ছেন। এতে মান্নান আরও চাপে পড়ে গেছেন।
বিএনপির ভেতরে এই আসনকে ঘিরে এখন তীব্র প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। একদিকে মান্নানের দীর্ঘদিনের প্রভাব, অন্যদিকে গিয়াসের বাড়তি তৎপরতা দুয়ের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠছে। আর এর মধ্যেই অন্যান্য প্রার্থীরা মান্নানকে কোণঠাসা করতে চেষ্টা করছেন। ফলে বিএনপির ভেতরকার দ্ব›দ্ব ও গ্রুপিং সামনে আরও প্রকট হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের নতুন সীমানা শুধু মান্নানের জন্য নয়, পুরো বিএনপির জন্যই একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। কে আসলে এই আসন থেকে চূড়ান্তভাবে মনোনয়ন পাবেন, সেটি নির্ভর করছে একমাত্র বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সিদ্ধান্তের ওপর। তবে রাজনৈতিক মহলে ইতোমধ্যেই জোর গুঞ্জন চলছে যে, মান্নানকে ঠেকাতে বিএনপির অভ্যন্তরেই গোপন জোট তৈরি হচ্ছে। বনানীর বৈঠক সেই জোটের প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে। সব মিলিয়ে বলা যায়, সোনারগাঁ-সিদ্ধিরগঞ্জ মিলিয়ে গঠিত নতুন আসনকে ঘিরে এখন অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে মান্নানের জন্য। গিয়াসের আগে থেকে থাকা প্রভাব, দূরদর্শিতা ও রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর অন্য প্রার্থীরাও যদি গিয়াসের পক্ষে দাঁড়ান, তাহলে মান্নানের টিকে থাকা আরও কঠিন হয়ে যাবে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনকে ঘিরে তাই নাটকীয়তার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এই আসনই হয়তো বিএনপির ভেতরে সবচেয়ে আলোচিত প্রতিদ্বদ্বিতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে।
আপনার মতামত লিখুন :