দীর্ঘদিনের অনিশ্চয়তা ও রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের পর নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের প্রার্থী হিসেবে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামী বাংলাদেশের জেলা সভাপতি মুফতি মনির হোসেন কাসেমীর নাম চূড়ান্ত হলেও, এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই আসনটিতে তৈরি হয়েছে জটিল রাজনৈতিক সমীকরণ। প্রার্থী ঘোষণার পর মাঠে যে চিত্র ফুটে উঠছে, তাতে জোটের জন্য স্বস্তির চেয়ে শঙ্কাই যেন বেশি।
সবচেয়ে বড় উদ্বেগের জায়গা হলো ধানের শীষ প্রতীক নিশ্চিত না হলে কাসেমীকে খেজুর গাছ প্রতীক নিয়ে ভোটের মাঠে নামতে হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতিতে তার জন্য ভরাডুবির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ স্থানীয় ভোটারদের বড় একটি অংশের কাছে কাসেমী এখনো অপরিচিত মুখ, তার ওপর অচেনা প্রতীক যুক্ত হলে ভোটারদের বিভ্রান্তি ও ভোট বিভাজনের ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যাবে।
জোটের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে বিএনপির একাধিক প্রভাবশালী নেতা ইতোমধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। এর ফলে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিতে শুরু করেছে। দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশা করেও বঞ্চিত হওয়ায় ভেতরে ভেতরে যে ক্ষোভ জমছিল, তা এখন নির্বাচনী মাঠে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষ করে জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন এবং ফতুল্লা বিএনপির সাবেক নেতা মোহাম্মদ শাহ আলমের অবস্থান জোটের প্রার্থীর জন্য বাড়তি চাপ তৈরি করছে। দু’জনই প্রকাশ্যে জানিয়েছেন জনগণের সমর্থন পেলে তারা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তুত। যদিও এখনো চূড়ান্ত ঘোষণা আসেনি, তবে তাদের মাঠপর্যায়ের তৎপরতা ভোটের সমীকরণ বদলে দেওয়ার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই আসনে বিএনপির কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কাসেমী নিজেই। কারণ তার নিজস্ব ভোটব্যাংক তুলনামূলকভাবে দুর্বল এবং দীর্ঘদিন ধরে মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা স্থানীয় নেতাদের মতো তৃণমূলভিত্তিক গ্রহণযোগ্যতা এখনও তিনি তৈরি করতে পারেননি। বিপরীতে সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বছরের পর বছর ধরে এলাকায় সাংগঠনিক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকায় ভোটারদের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগ ও আস্থার সম্পর্ক রয়েছে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, তফসিল ঘোষণার আগে বিএনপি দেশের বিভিন্ন আসনে একাধিক দফায় প্রার্থী ঘোষণা করলেও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনটি দীর্ঘদিন ঝুলে ছিল। তখন থেকেই রাজনৈতিক মহলে আলোচনা ছিল এই আসনে জোটগত কোনো কৌশল প্রয়োগ করা হতে পারে। শেষ পর্যন্ত সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে। এর আগেও ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে মুফতি মনির হোসেন কাসেমীকে মনোনয়ন দিয়েছিল বিএনপি, যদিও ফলাফল দলটির পক্ষে আসেনি।
মনোনয়ন নিশ্চিত হওয়ার পর নারায়ণগঞ্জে ফিরেই কাসেমীকে ঘিরে জোটের নেতাকর্মীরা শোভাযাত্রা আয়োজন করেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড এলাকা থেকে শুরু হওয়া মোটর শোভাযাত্রায় কয়েক হাজার নেতাকর্মী অংশ নেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কাসেমী বলেন, দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ঘরে ঘরে গিয়ে ভোট চাইবেন। সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী নিয়েও তিনি বিচলিত নন বলে দাবি করেন।
তবে মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। বিএনপির একটি অংশ প্রকাশ্যে আপত্তি না তুললেও নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ স্পষ্ট। বিশেষ করে ফতুল্লা অঞ্চলের নেতাকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে অবহেলার অভিযোগ তুলে আসছেন, যা নির্বাচনের সময় দলীয় সংহতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।
এদিকে মোহাম্মদ শাহ আলম এখনও স্থানীয় রাজনীতিতে একটি পরিচিত ও শক্ত নাম। সীমানা পুনর্র্নিধারণে সিদ্ধিরগঞ্জ বাদ পড়লেও ফতুল্লাকেন্দ্রিক এলাকায় তার অনুসারী ও সাংগঠনিক ভিত্তি অটুট রয়েছে। সভা-সমাবেশ, দোয়া মাহফিল ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি নিয়মিত মাঠে সক্রিয় থাকছেন।
অন্যদিকে গিয়াস উদ্দিন বক্তাবলী, ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ ও সোনারগাঁ এলাকায় ঘরোয়া বৈঠক, কর্মীসভা ও সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে নিজের অবস্থান আরও সুসংহত করছেন। বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, শক্তিশালী তৃণমূল নেটওয়ার্ক এবং বিরোধী জনভিত্তির ওপর নিয়ন্ত্রণের কারণে তিনি স্বতন্ত্র হলেও এই আসনে সবচেয়ে দৃশ্যমান ও প্রভাবশালী প্রতিদ্বন্দ্বিতে পরিণত হতে পারেন।
সব মিলিয়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন এখন বিএনপির জন্য শুধু একটি নির্বাচনী আসন নয়, বরং একটি কঠিন রাজনৈতিক পরীক্ষার ক্ষেত্র। জোটের কৌশল, দলীয় অসন্তোষ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থিতার সম্ভাবনা এই ত্রিমুখী চাপের মধ্যে শেষ পর্যন্ত কার ভাগ্যে কী লেখা আছে, তার ফয়সালা হবে ভোটের মাঠেই।


































আপনার মতামত লিখুন :