গত এক বছরে নারায়ণগঞ্জে একের পর এক পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর্থিক সংকট, উৎপাদন ব্যাহত হওয়া, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার, বায়ার না পাওয়া, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ নানা কারণে পরিস্থিতি ক্রমেই নাজুক হয়ে উঠেছে। শিল্পাঞ্চল পুলিশ সূত্র জানায়, এ সময়ে জেলার ২৬টি পোশাক কারখানাসহ সবমোট ৫৫টি কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে কর্মহীন হয়েছেন ১০ হাজারের বেশি শ্রমিক। পুরুষ শ্রমিকরা কেউ গ্রামে ফিরে দিনমজুরি করছেন, কেউ অটোরিকশা চালাচ্ছেন। অন্যদিকে নারী শ্রমিকরা গৃহকর্মীর কাজ নিয়েই বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন।
জেলা শিল্পাঞ্চল পুলিশ কার্যালয়ের হিসাবে, বর্তমানে নারায়ণগঞ্জে ছোট-বড় মিলে মোট ১ হাজার ৮৩৪টি কলকারখানা রয়েছে। এর মধ্যে গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৬টি পোশাক কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে। বন্ধ হওয়া পোশাক কারখানার মধ্যে রয়েছে লা মেইজন কচুর লিমিটেড, নীট গার্ডেন, একে ফ্যাশন লিমিটেড, মোল্লা নীট ফ্যাশনসহ অন্তত ১০টি বড় প্রতিষ্ঠান। এছাড়া টানা কয়েকদিনের লুটপাট, অগ্নিসংযোগে বন্ধ হয়ে যায় রুপগঞ্জের গাজী পাইপ লিমিটেড। এই কারখানায় প্রায় ৭ শতাধিক শ্রমিক কাজ করতেন।
কারখানাগুলো কেন বন্ধ হলো তা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অধিকাংশই বন্ধ হয়েছে আর্থিক সংকট, কাজের অভাব, শ্রমিকদের অবৈধ কর্মবিরতি, ভাঙ্গচুর, অগ্নিসংযোগ, গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং ব্যাংক ঋণের চাপের কারণে। স্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়া ছাড়াও গত এক বছরে ২০টি পোশাক কারখানা অস্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে, আবার কয়েকটি কারখানা লে-অফ ঘোষণা করেছে।
তবে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের তথ্য ভিন্ন। তাদের হিসেবে, নারায়ণগঞ্জে নিবন্ধনকৃত পোশাক কারখানা ১ হাজার ১০টি। এর মধ্যে গত এক বছরে মাত্র ৯টি কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে।
নীট গার্ডেন কারখানার কর্তৃপক্ষ রনি জানান, “আমাদের কারখানায় প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজারেরও বেশি পোশাক উৎপাদন হতো, যার বাজারমূল্য ছিল ২২ হাজার ডলারের বেশি। ব্যাংক খেলাপির কারণে কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হই। তবে সব শ্রমিককে বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হয়েছে।”
একইভাবে এএসটি গার্মেন্টসের মালিক আতিকুর রহমান বলেন, “অর্ডার কমে যাওয়ার পাশাপাশি আর্থিক সংকটে পড়ায় কারখানা চালানো সম্ভব হয়নি। কয়েক মাস ভর্তুকি দিয়ে টেনে নেওয়ার পরও শেষ পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে হয়েছে।”
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের নারায়ণগঞ্জ জেলা সভাপতি এমএ শাহীন বলেন, “কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া শ্রমিকদের অনেকেই এখন অটোরিকশা চালাচ্ছেন, কেউ গ্রামে ফিরে গেছেন, কেউ দিনমজুরি বা ছোট ব্যবসা করছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতায় কাজ কমে যাওয়ায় মালিকরা উৎপাদন বন্ধ করে দিচ্ছেন। সরকারের উচিত রাষ্ট্রীয় সহায়তায় কারখানাগুলো পুনরায় চালু করা। তা না হলে কিছু শ্রমিক অপরাধপ্রবণতায় জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে।”
তিনি আরও অভিযোগ করেন, “কয়েকটি পোশাক কারখানার মালিক আওয়ামী লীগপন্থী হওয়ায় অব্যবস্থাপনার কারণে সেগুলো বন্ধ হয়েছে।”
শিল্পাঞ্চল পুলিশ-৪, নারায়ণগঞ্জ জোনের পরিদর্শক (গোয়েন্দা) সেলিম বাদশা বলেন, “কারখানা বন্ধ হওয়ার প্রবণতা নতুন নয়। তবে বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি কিছু কারখানা আবার নতুন করে চালুও হয়েছে। শ্রমিকরা নিয়মিত বেতন পাচ্ছে কিনা তা আমরা তদারকি করি। তাদের অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ জেলার উপ-মহাপরিদর্শক রাজীব চন্দ্র ঘোষ বলেন, “আমাদের চেষ্টা থাকে কোনো কারখানা যেন স্থায়ীভাবে বন্ধ না হয়। কারণ একটি কারখানা বন্ধ হলে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েন।”
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি মোরশেদ সারোয়ার সোহেল বলেন, “করোনার পর থেকে ব্যাংক সুদ, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং ক্রমাগত অর্ডার কমে যাওয়ার কারণে পোশাক খাত দূর্বল হয়ে পড়েছে। গত ৫ই আগস্টের পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা যোগ হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও নাজুক হয়। ফলে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। স্থিতিশীলতা না আসলে আগামীতে আরও কারখানা বন্ধ হবে।”
নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দিপু বলেন, “বায়ার না পাওয়া, আর্থিক সংকট ও সিন্ডিকেটের কারণে শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে। কিছু মালিক পতিত সরকারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তারাও আত্মগোপনে চলে গেছেন। এসব সমস্যায় শ্রমিকরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সরকারের উচিত বিদেশি শক্তি ও অভ্যন্তরীণ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।”
আপনার মতামত লিখুন :