প্রতিনিয়ত পাড়া মহল্লা থেকে খবর আসছে ডেঙ্গু আক্রান্ত, পরক্ষণে মৃত্যুর খবর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন বিষয়টি নিয়মিত ঘটনা। তবে সেটা শুধু সোশ্যাল মিডিয়াতেই সীমাবদ্ধ না। নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আফজাল হোসেন পন্টির মতে শহর ও শহরতলীর প্রায় সব পরিবারের কেউ না কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। কার্যত পরিস্থিতি মহামারিরে রূপ নিয়েছে। কিন্তু বিপরীতে প্রশাসন একেবারেই উদাসীন। নেই কোন দৃশ্যমান ব্যবস্থা। ফলে মৃত্যুর মিছিল ক্রমশ বাড়ছে।
একদিকে থেমে থেমে বৃষ্টি। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ড্রেনেজ ব্যবস্থার বেহাল দশা। ফলে জলাবদ্ধতার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রধান বাহক এডিস মশার বিস্তার। কিন্তু এডিসের লার্ভা (ডিম) নির্মূলে জেলা প্রশাসন কিংবা সিটি করপোরেশনের আলাদা কোনো গবেষণা, জরিপ ও কর্মযজ্ঞ না থাকায় হু হু করে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা। বলা হচ্ছে, নারায়ণগঞ্জে ডেঙ্গুতে যেই ভয়ঙ্কর অবস্থা তৈরি হয়েছে তার পেছনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের অসচেতনতাও কম দায়ী নয়। তবে সরকারি অব্যবস্থাপনাকেই এজন্য এখন বেশি দয়ী করছেন সবাই।
আক্রান্ত ও মৃতের সঠিক তথ্য নেই
চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে আগষ্ট পর্যন্ত ৬ মাসে জেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতে ৯০০ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। আর গত ৩০ দিনে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসেই এই সংখ্যা ৪০০ ছাড়িয়ে গেছে।
নারায়ণগঞ্জের সিভিল সার্জন ডাক্তার আবুল ফজল মুহম্মদ মুশিউর রহমানের ভাষ্য, এই তথ্য শুধু সরকারি হাসপাতালগুলো থেকে নেয়া। বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য বা জেলায় সঠিক কতজন এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন সেটির হিসেব তার প্রতিষ্ঠানের কাছে নেই।
জনপ্রতিনিধির পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের ১৪ নং ওয়ার্ডের পানির ট্যাংকি এলাকার সাদ্দাম হোসেন নামে এক যুবকের সাথে হলে তিনি জানান, ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে তার মাকে গত এক সপ্তাহ শহরের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে হঠাৎ করে প্লাটিলেট কমে গেলে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একদিন পরই মারা যান সাদ্দামের মা।
জানা গেছে, শহরজুড়ে এমন আরো অনেকের ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে যারমধ্যে বেশির ভাগ শিশু। তবে এই তথ্য নেই সরকারি খাতায়।
নেই প্লাটিলেট মেশিন
তথ্য বলছে, ডেঙ্গু আক্রান্তদের বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত ও নিন্মমধ্যবিত্ত। যারা চিকিৎসার জন্য সবার আগে স্থানীয় সরকারী হাসপাতালগুলোতে গিয়ে উঠছেন। তবে জেলার কোনো সরকারি হাসপাতালে প্লাটিল্যাট মেশিন এবং আইসিইউ সুবিধা না থাকায় রোগীদের অবস্থা একটু শোচনীয় হলেই যেতে হচ্ছে ঢাকায়।
স্থানীয় স্বাস্থ্য খাতের সাথে সংশ্লিষ্টরা জানান, প্লাটিলেন মেশিন কোটি টাকার উপরে দাম। তাই এটি অনেক জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে নেই। এবং শহরের খানপুর ও ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে আইসিইউ মেশিন থাকলে আইসিইউ ডাক্তারদের শূন্যপদ থাকায় তা রোগীদের সেবায় ব্যবহার করা যাচ্ছেনা।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইউ) মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, আমরা ওষুধ দিচ্ছি এবং সবকিছুই ঠিকমতো চলছে। তবে কি কারণে এটা বাড়ছে তা বোঝা যাচ্ছেনা। মশার যেই বংশ বিস্তার সেখানে জিনগত পরিবর্তন হচ্ছে। যার করছে ওষুধেও কাজ হচ্ছেনা। আর বেশি ওষুধ দিলে তা আবার পরিবেশের জন্যও ক্ষতি। এখন এটা নিয়ে জাতীয় ভাবে গবেষণা দরকার। সেটি হলে এই সমস্যার টেকসই সমাধান হতে পারে।
নারায়ণগঞ্জ জেলার সিভিল সার্জন ডাক্তার মুশিউর রহমান বলেন, জেলায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে আমি এটা মনে করিনা। আমাদের কাছে মৃত্যুর খবরও নেই। হাসপাতালগুলোতে আমরা চেষ্টা করছি সেবা দিয়ে যেতে। কিন্তু জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন এবং উপজেলা পর্যায়ে আরো সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
নারায়ণগঞ্জ শহরের ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি নিয়ে নাসিকের ১৩ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ বলেন, সারা নারায়ণগঞ্জে বিশেষ কর্মসূচী নিতে হবে ডেঙ্গুর জন্য। সিটি করপোরেশন অথবা জেলা প্রশাসনের এই মুহূর্তে একটা ক্র্যাশ প্রোগাম নিতে হবে। এটা না হলে সামনে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। এটা করোনার মতোই ভয়াবহ হয়ে যাচ্ছে। একটা ওয়ার্ডে যতটুকু ওষুধ লাগে তা সিটি করপোরেশন কিংবা সরকার দিতে পারছেনা। তারপরও চেষ্টা চলছে যাতে কিছুটা হলেও এডিস মশা কমিয়ে আনা যায়। আমাদের জনগণকেও আরেকটু সচেতন হওয়া বিশেষ প্রয়োজন।
নাসিকের ১৫ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর অসিত বরণ বিশ^াস বলেন, রোগী বাড়ছে কিন্তু হাসপাতালে সেবা নেই। বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালের সেবার মান খুবই খারাপ। এখন যেটা দরকার তা হলো সরকারিভাবে গবেষণা ও সঠিক কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে এটা কমিয়ে আনা। সবাই ওষুধের কথা বলে। কিন্তু বেশি ওষুধ দিলে আবার সেটা আমাদের জন্যই ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এজন্য আমাদের সকলকে কাজ করতে হবে। যেকোনভাবে ঝুঁকি কমিয়ে আনা দরকার।
সিটি করপোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র ও ১৬, ১৭ ও ১৮ নং ওয়ার্ডের সাবেক সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর আফসানা আফরোজ বিভা বলেন, আমি সিটি করপোরেশনের তিনটি ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর ছিলাম। প্যানেল মেয়রের দায়িত্বও পালন করেছি। কখনো ডেঙ্গুর অবস্থা এমন দেখিনি। ঘরে ঘরে ডেঙ্গু আক্রান্ত আমার নিজের বাড়িতে ৪ জন রয়েছে। আমার ওয়ার্ডের বেশ কয়েক জনের মৃত্যু হয়েছে বলে শুনেছি। কিন্তু ঠিকমতো ওষুধ দেয়া হচ্ছেনা। আমি মনে করি এদিকে একটু খেয়াল রাখলে এবং আমরা নিজেরা সচেতন হলে এই সমস্যা কমে আসবে।
নারায়ণগঞ্জ শহরের ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি নিয়ে নাসিকের সাবেক কাউন্সিলর শাহেন শাহ আহম্মেদ বলেন, আমার ওয়ার্ডে সিটি করপোরেশন থেকে ঠিকমতো ওষুধ দেয়া হচ্ছেনা। তাই ডেঙ্গু খুবই খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ঘরে ঘরে রোগী আবার মারাও গেছে। এমন অবস্থা আমার ওয়ার্ডে আগে কখনো দেখিনি। এ অবস্থা চলতে থাকলে সামনে আরো খারাপ হবে।
নাসিকের ২৩ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আবুল কাউসার আশা বলেন, পর্যাপ্ত ওষুধের ব্যবস্থা নেই। ঘরে ঘরে ডেঙ্গু রোগী। মৃত্যুর খবরও অনেক জায়গা থেকে শুনতে পাচ্ছি। আগের আমার ওয়ার্ডের ড্রেনগুলোর মুখ খোলা ছিলো তাই চাইলেই সেটা উঠিয়ে পরিষ্কার করা যেতো। এখন তা করা যায়না বলে ভেতরেই মশার বংশবিস্তার হচ্ছে। তারপর আমরা নিজেরাও সচেতন না। ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে হলে আমাদের নিজেদেরও সচেতন হতে হবে।
নাসিকের ৮,৯, ১০ নং ওয়ার্ডের সাবেক নারী সংরক্ষিত কাউন্সিলর আয়শা আক্তার দিনা বলেন, আমার এলাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি আগের চেয়ে অবনতি হয়েছে। ওষুধ দেয়া হচ্ছে কিন্তু তারপরও ডেঙ্গুর প্রভাব বাড়ছে। এটা কি কারণে হচ্ছে তা বুঝতে পারছিনা।
আপনার মতামত লিখুন :