নারায়ণগঞ্জে প্রতিদিন বাড়লে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। এ শহরের হাসপাতাল রেখে রোগীরা যাচ্ছে ঢাকাতে। সেখানে বিভিন্ন হাসপাতালে মারা যাচ্ছেন তারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন বিষয়টি নিয়মিত ঘটনা।
সিভিল সার্জন ডা. এ এফ এম মুশিউর রহমান জানান, নারায়ণগঞ্জে কোনো হাসপাতালে প্লাটিলেট কাউন্ট বা সেপারেশন মেশিন নেই। এ কারণে জটিল অবস্থার রোগীদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ বা মহাখালীর ডিএনসিসি হাসপাতালে পাঠাতে হচ্ছে। প্রতিদিন সদর হাসপাতাল ও ৩০০ শয্যা হাসপাতালে শতাধিক রোগী ভর্তি হচ্ছে। বেড সীমিত হওয়ায় অনেককে ঢাকায় পাঠানো বাধ্যতামূলক।
চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গুর জটিল অবস্থায় রোগীর প্লাটিলেট কমে যায়, যা রক্তক্ষরণ ঝুঁকি বাড়ায়। প্লাটিলেট ট্রান্সফিউশন একমাত্র কার্যকর সমাধান। ঢাকায় কয়েকটি হাসপাতালে এই সুবিধা থাকলেও নারায়ণগঞ্জে একটিও নেই। প্রতিদিন অন্তত ১৫ থেকে ২০ রোগীকে মেশিন না থাকায় ঢাকায় পাঠাতে হচ্ছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, একটি আধুনিক প্লাটিলেট সেপারেশন মেশিনের মূল্য প্রায় ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা। বাজেট সীমাবদ্ধতা ও প্রশাসনিক জটিলতার কারণে এটি এখনও কেনা হয়নি।
এদিকে নগরবাসী বলছেন ভিন্নকথা। তারা বলছেন, নারায়ণগঞ্জ দেশের অন্যতম ধনী জেলা। ব্যবসা বাণিজ্য কেন্দ্রীক এ নগরেও আছে ধনকুবের। নির্বাচন ঘিরে রাজনীতিতে ঢালছেন কোটি কোটি টাকা। কিন্তু একটি প্লাটিলেট মেশিন কেনার মত আগ্রহ দেখাচ্ছে না কেউ।
বিষয়টি নিয়েও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আছে নানা মতামত। কেউ কেউ বলছেন, এমপি প্রার্থী হিসেবে মডেল গ্রুপের মাসুদুজ্জামান, প্রাইম গ্রুপের আবু জাফর আহমেদ বাবুল প্রচুর টাকার মালিক। এছাড়াও আছে নারায়ণগঞ্জ চেম্বারের সভাপতি মুস্তাফিজুর রহমান ভূইয়া দিপু, বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদের মত কোটিপতি নেতা। তাঁরা চাইলেই এ ধরনের মেশিন নারায়ণগঞ্জের হাসপাতালে স্থাপন করতে পারেন নিজ উদ্যোগে। তাহলেই ঝুঁকি কমবে এ নগরের।
নারায়ণগঞ্জে ডেঙ্গুর মহামারি রূপ
প্রতিনিয়ত পাড়া মহল্লা থেকে খবর আসছে ডেঙ্গু আক্রান্ত, পরক্ষণে মৃত্যুর খবর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন বিষয়টি নিয়মিত ঘটনা। তবে সেটা শুধু সোশ্যাল মিডিয়াতেই সীমাবদ্ধ না। নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আফজাল হোসেন পন্টির মতে শহর ও শহরতলীর প্রায় সব পরিবারের কেউ না কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। কার্যত পরিস্থিতি মহামারিরে রূপ নিয়েছে। কিন্তু বিপরীতে প্রশাসন একেবারেই উদাসীন। নেই কোন দৃশ্যমান ব্যবস্থা। ফলে মৃত্যুর মিছিল ক্রমশ বাড়ছে।
একদিকে থেমে থেমে বৃষ্টি। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ড্রেনেজ ব্যবস্থার বেহাল দশা। ফলে জলাবদ্ধতার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রধান বাহক এডিস মশার বিস্তার। কিন্তু এডিসের লার্ভা (ডিম) নির্মূলে জেলা প্রশাসন কিংবা সিটি করপোরেশনের আলাদা কোনো গবেষণা, জরিপ ও কর্মযজ্ঞ না থাকায় হু হু করে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা। বলা হচ্ছে, নারায়ণগঞ্জে ডেঙ্গুতে যেই ভয়ঙ্কর অবস্থা তৈরি হয়েছে তার পেছনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের অসচেতনতাও কম দায়ী নয়। তবে সরকারি অব্যবস্থাপনাকেই এজন্য এখন বেশি দয়ী করছেন সবাই।
আক্রান্ত ও মৃতের সঠিক তথ্য নেই
চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে আগষ্ট পর্যন্ত ৬ মাসে জেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতে ৯০০ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। আর গত ৩০ দিনে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসেই এই সংখ্যা ৪০০ ছাড়িয়ে গেছে।
নারায়ণগঞ্জের সিভিল সার্জন ডাক্তার আবুল ফজল মুহম্মদ মুশিউর রহমানের ভাষ্য, এই তথ্য শুধু সরকারি হাসপাতালগুলো থেকে নেয়া। বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য বা জেলায় সঠিক কতজন এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন সেটির হিসেব তার প্রতিষ্ঠানের কাছে নেই।
জনপ্রতিনিধির পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের ১৪ নং ওয়ার্ডের পানির ট্যাংকি এলাকার সাদ্দাম হোসেন নামে এক যুবকের সাথে হলে তিনি জানান, ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে তার মাকে গত এক সপ্তাহ শহরের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে হঠাৎ করে প্লাটিলেট কমে গেলে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একদিন পরই মারা যান সাদ্দামের মা।
জানা গেছে, শহরজুড়ে এমন আরো অনেকের ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে যারমধ্যে বেশির ভাগ শিশু। তবে এই তথ্য নেই সরকারি খাতায়।
সাবেক কাউন্সিলরদের মন্তব্যে উদ্বেগ
নারায়ণগঞ্জ শহরের ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি নিয়ে নাসিকের ১৩ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ বলেন, সারা নারায়ণগঞ্জে বিশেষ কর্মসূচী নিতে হবে ডেঙ্গুর জন্য। সিটি করপোরেশন অথবা জেলা প্রশাসনের এই মুহূর্তে একটা ক্র্যাশ প্রোগাম নিতে হবে। এটা না হলে সামনে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। এটা করোনার মতোই ভয়াবহ হয়ে যাচ্ছে। একটা ওয়ার্ডে যতটুকু ওষুধ লাগে তা সিটি করপোরেশন কিংবা সরকার দিতে পারছেনা। তারপরও চেষ্টা চলছে যাতে কিছুটা হলেও এডিস মশা কমিয়ে আনা যায়। আমাদের জনগণকেও আরেকটু সচেতন হওয়া বিশেষ প্রয়োজন।
নাসিকের ১৫ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর অসিত বরণ বিশ্বাস বলেন, রোগী বাড়ছে কিন্তু হাসপাতালে সেবা নেই। বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালের সেবার মান খুবই খারাপ। এখন যেটা দরকার তা হলো সরকারিভাবে গবেষণা ও সঠিক কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে এটা কমিয়ে আনা। সবাই ওষুধের কথা বলে। কিন্তু বেশি ওষুধ দিলে আবার সেটা আমাদের জন্যই ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এজন্য আমাদের সকলকে কাজ করতে হবে। যেকোনভাবে ঝুঁকি কমিয়ে আনা দরকার।
সিটি করপোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র ও ১৬, ১৭ ও ১৮ নং ওয়ার্ডের সাবেক সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর আফসানা আফরোজ বিভা বলেন, আমি সিটি করপোরেশনের তিনটি ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর ছিলাম। প্যানেল মেয়রের দায়িত্বও পালন করেছি। কখনো ডেঙ্গুর অবস্থা এমন দেখিনি। ঘরে ঘরে ডেঙ্গু আক্রান্ত আমার নিজের বাড়িতে ৪ জন রয়েছে। আমার ওয়ার্ডের বেশ কয়েক জনের মৃত্যু হয়েছে বলে শুনেছি। কিন্তু ঠিকমতো ওষুধ দেয়া হচ্ছেনা। আমি মনে করি এদিকে একটু খেয়াল রাখলে এবং আমরা নিজেরা সচেতন হলে এই সমস্যা কমে আসবে।
নারায়ণগঞ্জ শহরের ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি নিয়ে নাসিকের সাবেক কাউন্সিলর শাহেন শাহ আহম্মেদ বলেন, আমার ওয়ার্ডে সিটি করপোরেশন থেকে ঠিকমতো ওষুধ দেয়া হচ্ছেনা। তাই ডেঙ্গু খুবই খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ঘরে ঘরে রোগী আবার মারাও গেছে। এমন অবস্থা আমার ওয়ার্ডে আগে কখনো দেখিনি। এ অবস্থা চলতে থাকলে সামনে আরো খারাপ হবে।
নাসিকের ২৩ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আবুল কাউসার আশা বলেন, পর্যাপ্ত ওষুধের ব্যবস্থা নেই। ঘরে ঘরে ডেঙ্গু রোগী। মৃত্যুর খবরও অনেক জায়গা থেকে শুনতে পাচ্ছি। আগের আমার ওয়ার্ডের ড্রেনগুলোর মুখ খোলা ছিলো তাই চাইলেই সেটা উঠিয়ে পরিষ্কার করা যেতো। এখন তা করা যায়না বলে ভেতরেই মশার বংশবিস্তার হচ্ছে। তারপর আমরা নিজেরাও সচেতন না। ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে হলে আমাদের নিজেদেরও সচেতন হতে হবে।
নাসিকের ৮,৯, ১০ নং ওয়ার্ডের সাবেক নারী সংরক্ষিত কাউন্সিলর আয়শা আক্তার দিনা বলেন, আমার এলাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি আগের চেয়ে অবনতি হয়েছে। ওষুধ দেয়া হচ্ছে কিন্তু তারপরও ডেঙ্গুর প্রভাব বাড়ছে। এটা কি কারণে হচ্ছে তা বুঝতে পারছিনা।
আপনার মতামত লিখুন :