গত বছরেরর ৫ আগস্ট পরবর্তিত পরিস্থিতির মধ্যে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে আলোচনায় চলে আসছেন নারায়ণগঞ্জ জামায়াতে ইসলামী। তারা বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে নারায়ণগঞ্জবাসীর নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছেন। বিপরীতে বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে সমালোচনা রয়েছেন হেফাজত। সবশেষ ফিলিস্তিনের গাজায় মুসলিম গণহত্যার প্রতিবাদে নারায়ণগঞ্জ উলামা পরিষদের উদ্যোগে বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত ২১ মার্চ জুমআর নামাজের পর ঐতিহাসিক ডিআইটি মসজিদ চত্বরে এই বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। কিন্তু এই সমাবেশে দেখা যায়নি হেফাজত নেতা মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান সহ তার অনুসারী নেতাকর্মীদের। সেই সাথে মাওলানা ফেরদাউসুর রহমানদের উদ্যোগে আয়োজিত ইফতার মাহফিলেও হেফাজতের বিশাল একটি অংশের নেতাকর্মীদের দেখা যায়নি। তারা নিজেদের কতৃত্বের লড়াইয়েই ব্যস্ত থাকেন।
জানা যায়, বিগত প্রায় ১৬ বছর ধরেই ক্ষমতায় ছিলো আওয়ামী লীগ। আর এই ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সারাদেশের মতো নারায়ণগঞ্জেও জামায়াত ইসলামী নেতাকর্মীরা বিভিন্নিভাবে অত্যাচার নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্যে সভা সমাবেশ করতে পারতেন না।
এরই মধ্যে গত ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। আর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই নিরবে কাজ করে যেতে থাকেন বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর শাখা। বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্ম নিয়ে তারা জনসাধারণের মাঝে উপস্থিত হচ্ছেন। তাদের মাঝে নেই কোনো দখলদারিত্ব নেই কোনো পদ-পদবীর লড়াই।
জামায়াতে ইসলাম নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগরের নেতাকর্মীরা নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্ম করে যাচ্ছেন। প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন সেবা নিয়ে জনগণের সামনে উপস্থিত হচ্ছেন। একই সাথে সাংগঠনিক সভা সমাবেশও করে যাচ্ছেন। সাংগঠনিক সভাগুলোতেও নেই কোনো বিশৃঙ্খলা নেই কোনো নিজেদের জাহির করার লড়াই। জনসম্পৃক্ততামূলক কাজে নিজেদেরকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রাখছেন। সবশেষ এবারের রমজান মাসকে তারা বেশ ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছেন।
এর আগে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জের নিহত ও আহতদের বাসায় বাসায় গিয়ে হাজির হতে থাকেন নারায়গঞ্জ জামায়াত ইসলামের নেতাকর্মীরা। বিভিন্ন বাসায় বাসায় গিয়ে তারা নিরবেই আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেন। কারও কারও বেলায় সকল দায়িত্ব নেন জামায়াত ইসলাম। বিভিন্ন মেডিকেল সেবা নিয়েও তারা জনগণের দৌড়গোড়ায় যাচ্ছেন।
একই সাথে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর জামায়াত ইসলাম সাংগঠনিকভাবেও বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন। সেই সাথে তাদের সভা সমাবেশগুলোতে কোনো বিশৃঙ্খলা কিংবা ফটোসেশনের প্রতিযোগিতাও দেখা যায়নি। নিজেদের মধ্যে নেতৃত্বেরও কোনো প্রতিযোগিতা দেখা যায়নি।
বিপরীতে আওয়াম লীগ সরকারের পতনের পর নারায়ণগঞ্জ হেফাজত ইসলাম নিজেদের মধ্যে নেতৃত্বের দ্বদ্বে জড়িয়ে যান। নিজেরা নিজেদের মধ্যে দলাদলিতে মেতে উঠেছেন। একে অপরের বিরুদ্ধে নানা কুৎসা রটনায় লিপ্ত হয়েছেন। সেই সাথে কেউ কাউকে ছাড় দেননি। ইসলাম যেখানে ক্ষমতার লড়াই সমর্থন করে না নিজ থেকে জোর করে পদবী প্রাপ্তিতে সমর্থন করে সেখানে নারায়ণগঞ্জ হেফাজত ইসলামের নেতারা ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য লড়াইয়ে অবর্তীর্ণ হচ্ছেন। এমনকি তারা মসজিদের মিম্বরকে রাজনৈতিক মঞ্চে রুপ দিয়েছেন।
বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালিন সময়ে মহানগর হেফাজত ইসলামের সভাপতি মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান ও তার অনুসারিরা শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমানের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতেন। সেই সাথে তাদের অনুসারীদের সাথেও মাওলানা ফেরদাউসের ভালো সম্পর্ক ছিলো। বিভিন্ন সময় ওসমানদের স্বার্থ আদায়ে মাওলানা ফেরদাউস হেফাজতের নেতাকর্মীদের নিয়ে কর্মসূচি পালন করতেন।
সেই সাথে বিভিন্ন সময় হেফাজত ইসলামের নেতাকর্মীরা গ্রেফতার হলেও ফেরদাউস থাকতো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান মহানগর হেফাজত ইসলামকে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাবস্থায় কেউ কিছু বলতো না।
তার আগে ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি হেফাজত প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রাজধানীর পাশ্ববর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জ হেফাজতের নেতাকর্মীরা আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা রেখে আসছিলেন। ঢাকার পাশপাশি নারায়ণগঞ্জের রাজপথও তারা সরব রেখেছেন। রাজধানীর প্রবেশপথ কাঁচপুর মহাসড়কে তারা সহিংসতা চালিয়েছেন। হেফাজতের প্রতিটি কর্মসূচিতের তারা সরব ভূমিকা পালন করেছেন।
এরই মধ্যে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরোধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম ব্লগার আহম্মেদ রাজীব হায়দার শোভনকে হত্যার ঘটনায় তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়া গোল চত্বরকে ‘রাজীব চত্বর’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। ২০১৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি চাষাঢ়ায় জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ, রাজাকারদের ফাঁসির দাবি ও ব্লগার রাজীব হত্যার প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশের আগে নারায়ণগঞ্জের সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমান আনুষ্ঠানিকভাবে এ ঘোষণা দিয়ে সেখানে সাইনবোর্ড গেঁথে দেন এবং ফলক উন্মোচন করেন।
কিন্তু সেই ‘রাজীব চত্বর’ ঘোষণার কয়েকদিনের মধ্যেই শহরের ডিআইটি এলাক থেকে মিছিল নিয়ে এসে রাজীব গুড়িয়ে দেয়া হয়। যে মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন হেফাজতের নেতাকর্মীরা।
এরপর ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানী ঢাকায় শাপলা চত্ত্বর কায়েম করা হয়। আর এই শাপলা চত্ত¡রে ঢাকার পাশ্ববর্তী জেলা হিসেবে নারায়ণগঞ্জের হেফাজতের নেতারা সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন। এভাবে একের পর এক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নারায়ণগঞ্জ হেফাজতের নেতাকর্মীদের সাথে ধর্মপ্রাণ মুসুল্লিদের নজর কাড়ে। তাদের যে কোনো কর্মসূচিতেই সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসুল্লিরা অংশগ্রহণ করেন।
তবে এই আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যেই মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমানের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে আসছিলেন। বিভিন্ন সময় তাদের সম্পর্কের ঘনিষ্টতাও পরিরক্ষিত হয়। ২০২১ সালের ২০ মার্চ আলীরটেকের ডিক্রিরচর ঈদগাহ মাঠে ইসলামি মহাসম্মেলন করে ওলামা পরিষদ। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন তৎকালিন এমপি শামীম ওসমান। এসময় তিনি মাওলানা ফেরদাউসুর রহমানকে তার ছোট ভাই বলে সম্বোধন করেছিলেন। যা স্থানীয় রাজনীতিতে ব্যপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছিলো।
এর আগে ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে ২০১৬ সালের ১৩ মে বন্দরের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটে। স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান সেদিন শ্যামল কান্তিকে কান ধরে উঠবস করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরে এই ঘটনা প্রকাশ পেলে সারাদেশজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠে। এই ঘটনায় চাপের মুখে পড়ে যান ওসমান পরিবার।
ঠিক সে সময়েই তাদের পাশে দাঁড়ান নারায়ণগঞ্জ হেফাজতের নেতারা। ওই বছরের ২০ মে নারায়ণগঞ্জ জেলা হেফাজত আয়োজিত শহরের ডিআইটি জামে মসজিদের সামনে ‘নারায়ণগঞ্জের সর্বস্তরের মুসলিম জনতা’ ব্যানারে সমাবেশ করা হয়। সমাবেশ থেকে নারায়ণগঞ্জ হেফাজত নেতারা শ্যামল কান্তিকে শাস্তি দিতে সরকারকে ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন। সেই সাথে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দাবি মানা না হলে হরতাল- অবরোধ করে দেশ অচল করে দেয়ার ঘোষণা দেন।
অন্যদিকে ২০১৭ সালের ২০ এপ্রিল ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিষয়ে কটূক্তির অভিযোগ এনে নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম (ক অঞ্চল) অশোক কুমার দত্তের আদালতে হেফাজতে ইসলাম নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সমন্বয়ক মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান এই মামলা করেন।
মামলার আরজিতে উল্লেখ করা হয়, ওই বছরের ৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে একটি অনুষ্ঠানে রফিউর রাব্বি বক্তব্য দেন। এ সময় তিনি ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু কথা বলেন। এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে রফিউর শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
২০২১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মসজিদ ভেঙে শপিংমল ও মাদ্রাসা উচ্ছেদ করে পার্ক করার অভিযোগ এনে মেয়র আইভীর বিরুদ্ধে সমাবেশ করে নারায়ণগঞ্জ ওলামা পরিষদ। এদিন জুমার নামাজের পর শহরের চাষাঢ়া এলাকার বাগে জান্নাত মসজিদের সামনে এই সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
সমাবেশের সভাপতি হেফাজতে ইসলামের নারায়ণগঞ্জ মহানগর শাখার সভাপতি ফেরদাউসুর রহমান বলেছিলেন, মাসদাইর কবরস্থানের সামনে যেই মাদ্রাসা ছিলো সেটা নাকি সিটি করপোরেশন ভাঙে নাই। আমার প্রশ্ন সিটি করপোরেশন যদি না ভাঙে তাহলে এই সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি কে ভাঙলো। কার এতো বড় শাহস, যে এই মাদ্রাসা ভাইঙ্গা দিলো। আসলে ওনার (মেয়র আইভী) কোরআন তেলোয়াত ভালো লাগেনা। সে মাথায় কাপড় দিতে চায়-না, পুরুষ সাজতে চায়।
এভাবে একের পর বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে ফেরদাউসের নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জ হেফাজতের নেতারা ওসমানীয় হেফাজত হিসেবে আখ্যা পান। আর এই অখ্যা থেকে এখনও বের হয়ে আসতে পারেননি হেফাজত নেতা মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান সহ তার অনুগামী নেতাকর্মীরা।
আপনার মতামত লিখুন :