২০২১ সালের নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয় নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের নির্বাচন। সেখানে বেশ জোরালো প্রার্থী ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের হাত পাখা। তাদের অবস্থান এতটাই সুসংহত ছিল না শেষ পর্যন্ত তাদের বসাতে ওসমান পরিবারের ক্যাডার বাহিনী মারধর থেকে শুরু করে অস্ত্রের ভয় দেখায়। গত ৫ বছরে এ দুটি ইউনিয়ন সহ পুরো ফতুল্লাতে হাতপাখার অবস্থান আরো সুসংহত হয়েছে এবং ধারাবাহিক সবগুলো নির্বাচনে অংশ ও প্রত্যক্ষ করার কারণে তারা বেশ শক্তিশালী। সে হিসেবে আসছে সংসদ নির্বাচনে এখানে হাতপাখার প্রার্থীকে নিয়ে চ্যালেঞ্জ পোহাতে হবে অন্যদের। বিপরীতে এ আসনে জামায়াতে ইসলামীও মানবিক কিছু কর্মকান্ড করে আলোচনায় এসেছেন। লালপুরে পানিবন্দী মানুষের পাশে থাকার ঘোষণা ও মাঠে থেকে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া, শীতকালে বস্ত্র বিতরণ, বিভিন্ন সময়ে অনুদান প্রদান, কাশীপুরের জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করা সহ আরো কিছু ঘটনায় জামায়াতে ইসলামীর প্রতি সাধারণ ভোটারদের দাগ কেটেছে। তবে তলানীতে আছে জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম। নিজেদের ভেতরে ওসমান পরিবারের লোকজনদের স্থান দেওয়া, বিতর্কিতদের পাশে রাখার কারণে দিন দিন ইমেজ নষ্ট হচ্ছে জমিয়তের সম্ভাব্য প্রার্থী মনির হোসাইন কাশেমী। কয়েকটি ইউনিয়নে সভা সমাবেশ কার্যত ফ্লপ হয়েছে যেখানে সাধারণ মানুষের কোন সম্পৃক্ততা ছিল না। কয়েকটি মাদ্রাসার ছাত্রদের বসানো হয় চেয়ারে। তবে ব্যানার ফেস্টুনে কাশেমীকে দেখা গেলেও এখন পর্যন্ত কোন সামাজিক কর্মকাণ্ডে দেখা না যাওয়াতে ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা। তারা বলছেন, বিএনপির উপর ভর করে পরগাছার মত আগাচ্ছে জমিয়ত।
বিনা ভোটে এমপি হওয়া শামীম ওসমান ও তার পছন্দের প্রার্থীরা ভোটে ভীষণ ভয় পেতেন। ২০২১ সালে সবশেষ নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার এনায়েতনগর ও কাশীপুর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে প্রতিদ্ব›দ্বীতায় থাকা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের হাতপাখা প্রতিকের দুই প্রার্থীকে বসিয়ে দেয়া হয়।
সূত্র বলছে, ওই ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি দলীয় প্রার্থীরা আগে থেকে দূরে ছিলেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনীত প্রার্থীরা এগিয়ে থাকার কথা। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরাই শামীম ওসমানের পছন্দেরর প্রার্থীদের কারণ হিসেবেই আবির্ভাব হয়। সদর উপজেলার কাশীপুর ইউনিয়নে হেভিয়েট প্রার্থী ছিলেন মোমেন সিকদার যিনি সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন। তাকে এমপি শামীম ওসমান এবার নির্বাচন থেকে বসিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত ইসলামী আন্দোলনের ওমর ফারুক নির্বাচনে আর থাকেননি। তার সাথে সাথে এনায়েতনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী হাজী আব্দুস সালামও সরে দাঁড়িয়েছেন। যেখানে শামীম ওসমানের আরেক পছন্দের প্রার্থী মো. আসাদুজ্জামান ছিলেন। আর তাদের দুইজনকে বসিয়ে দেয়ার জন্য দীর্ঘক্ষণ সময় ধরে বৈঠক করতে হয়েছে শামীম ওসমানের অনুগামীদের। নির্বাচনের একদিন আগে ১০ নভেম্বর বিকেলে ফতুল্লার লামাপাড়া ইসলামী পাঠাগারে অ্যাডভোকেট খোকন সাহার নেতৃত্বে তারা গিয়ে হাজির হন। সেখানে আগে থেকেই দুই প্রার্থী হাজী আব্দুস সালাম ও ওমর ফারুক উপস্থিত ছিলেন। দীর্ঘক্ষণ সময়ে নিয়ে তাদের সাথে বৈঠক শেষে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি আনোয়ার হোসেন জিহাদী ঘোষণা দেন তাদের প্রার্থীরা সরে যাওয়ার। ফলে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার এনায়েতনগর ও কাশীপুর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে কোনো প্রতিদ্বদ্বীতা ছিল না।
সরে যাওয়া প্রসঙ্গে সেদিন নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি আনোয়ার হোসেন জিহাদী বলেন, নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার আওতাধীন এনায়েতনগর ইউনিয়ন পরিষদ এবং কাশীপুর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন চেয়ারম্যান প্রার্থী হাজী আব্দুস সালাম এবং ওমর ফারুক প্রার্থী হওয়ায় আমাদের নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান গত পরশুদিন আমাদের সাথে মতবিনিময় সভায় বসেছিলেন। সেখানে তিনি আমাদের এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার্থে আমাদের সকল ইউনিয়নে প্রার্থী নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়ায় তাহলে তাদের দলীয় প্রার্থী তারা বিনা প্রতিদ্ব›দ্বীতায় অথবা আমদের এজেন্ট না দেয়া হলে তারা নির্বাচিত হতে পারবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। সেটা আমরা বিবেচনা করছি এবং ফোরামে আলোচনা করেছি। সে হিসেবে শান্তি শৃঙ্খলার রক্ষার্থে ইসলাম শান্তির ধর্ম আমাদের প্রার্থীর কর্মী সমর্থকদের সাথে আলোচনা করে আমরা নারায়ণগঞ্জ জেলার ইসলামী আন্দোলনের সর্বোচ্চ ফোরাম আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা নির্বাচনে আমাদের প্রার্থীদ্বয় নির্বাচনী কার্যক্রম থেকে সড়ে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিচ্ছি আনুষ্ঠানিভাবে। নির্বাচনে আমাদের কোনো এজেন্ট দিবো না। আমাদের কোন এজেন্ট থাকবে না। আমরা দলীয়ভাবে নির্বাচন কার্যক্রম থেকে সরে গেলাম।
স্থানীয়রা বলছেন, ফতুল্লা এলাকাতে ইসলামী আন্দোলনের একটি ভোট ব্যাংক রয়েছে। সেটা ২০২১ সালের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেই প্রমাণিত হয়েছে। এবার এ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে মুফতি ইসমাইল সিরাজীকে। তিনিও ইতোমধ্যে মাঠে নেমেছেন। সকল ইউনিয়নের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলছেন। ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন। অচিরেই আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণায় নামবেন এ ইসলামী বক্তা। সকলকে নিয়ে মাঠে নামতে পারলে হাতপাখার বাতাস এবার জোরেই বইবে মনে করা হচ্ছে।
জামায়াতের প্রার্থী মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল জব্বার জামায়াতে ইসলামী ছাত্র সংগঠন ‘ছাত্রশিবির’ কেন্দ্রীয় কমিটির সম্মেলনের মাধ্যমে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি। এরপর তিনি ২০১৪ সালের ২৭ জানুয়ারি সম্মেলনে ২২ থেকে ২৪ জানুয়ারি সারাদেশে ভোটের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ছাত্রশিবিরের সভাপতি নির্বাচিত হন। মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল জব্বার এর আগে ছাত্রশিবির কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক, সাহিত্য সম্পাদক, প্রকাশনা সম্পাদক এবং চট্টগ্রাম মহানগরী দক্ষিণ ও উত্তর শাখার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ছিলেন। ২০২৪ সালের ২৯ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামী নারায়ণগঞ্জ মহানগর সভাপতি নির্বাচিত মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল জব্বার। এর আগে তিনি জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় কমিটির কর্মপরিষদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল জব্বার ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামীলীগ সরকার বিরোধী প্রচারণা করেছেন।
২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হঠাৎ নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লার সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে ২০ দলীয় জোটের শরিক দল জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের প্রার্থী হন। এতে ওই সময়ে মুফতি মনির হোসাইন কাসেমীকে নিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে সমালোচনা শুরু হয়। তৎকালীন জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি শিল্পপতি শাহ আলম ও সাবেক সংসদ সদস্য মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিনকে বাদ দিয়ে ২০ দলীয় জোটের শরিক দল প্রার্থীকে ধানের শীষে ঘোষণা করায় বিএনপির নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ প্রকাশ করেন। বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মীই মুফতি মনির হোসাইন কাসেমী সম্পর্কে ভাল করে জানেন না। কোনও আন্দোলন সংগ্রামেও তাকে রাজপথে দেখা যায়নি বলে তাদের দাবি। এলাকায় অপরিচিত মনির হোসেন কাসেমীকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ায় জেলা বিএনপির সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা ওই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ ও হতাশ হন। এই মনোনয়ন বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন এসব নেতা-কর্মী। মনির হোসেন কাসেমীকে ভোটের মাঠে দেখা যায়নি এবং কোনো ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট দেননি। নির্বাচনের চার দিন আগে অসুস্থতার অজুহাতে হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। দীর্ঘদিন পর তিনি মাঠে নামলেও সাড়া পাচ্ছেন না। গত কয়েক মাসে জনকল্যাণমুখী কোন কাজে ছিল না জমিয়ত। বরং তারা কয়েকটি ইউনিয়নে আলাদা সভা সমাবেশ করেছেন। সেখানেও উপস্থিতি ছিল খুবই কম। জমিয়ত মনে করছেন তারা ধানের শীষের উপর ভর করেই নির্বাচনে জিতে যাবেন। কিন্তু এবার সেটা নিয়েও বেশ বেগ পোহাতে হবে। কারণ জমিয়তের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির অভাব।
আপনার মতামত লিখুন :