News Narayanganj
Bongosoft Ltd.
ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫, ২ পৌষ ১৪৩২

নারায়ণগঞ্জে গণহত্যা বধ্যভূমি গণকবর


দ্যা নিউজ নারায়ণগঞ্জ ডটকম | স্টাফ রিপোর্টার প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৫, ২০২৫, ১২:৩৬ পিএম নারায়ণগঞ্জে গণহত্যা বধ্যভূমি গণকবর

১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে হত্যাযজ্ঞের সূচনা করেছিল, একেবারে শেষ দিকে এসে পরাজয়ের আগমুহূর্তে তা রূপ নেয় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পরিকল্পিত হত্যাকান্ডে। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তখন তাদের এদেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় বেছে বেছে হত্যা করেছিল জাতির অগ্রণী শিক্ষক, লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও চিকিৎসকদের। এসব হত্যার কারণটি স্পষ্ট, পরাজয় নিশ্চিত জেনে তারা চেয়েছিল স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়া দেশটিকে মেধায়-মননে পঙ্গু করে দিতে।

বক্তাবলী গণহত্যা

নারায়ণগঞ্জের পশ্চিমাঞ্চল ধলেশ্বরীর পাড় ধরে বক্তাবলীর ২২টি গ্রাম। বক্তাবলী ও আলীরটেক দুটি ইউনিয়নের সমন্বয়ে বক্তাবলী পরগনা। তখন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জের দিকে সরে যাওয়ার নিরাপদ পথটি ছিল এই বক্তাবলী। বক্তাবলীর পূর্বে ও দক্ষিণে ধলেশ্বরী, আর উত্তরে বুড়িগঙ্গা নদী। দুই নদীর মাঝখানে বক্তাবলীর ২২টি গ্রামের অবস্থান।

নারায়ণগঞ্জ শহরের কয়েকজন রাজাকারের সহযোগিতায় ১৯৭১-এর ২৯ নভেম্বরের ঘন কুয়াশার রাতে ৩টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে পুরো বক্তাবলী। গানবোট নিয়ে ধলেশ্বরীর বুকে তারা অবস্থান নেয়। সুবেহ সাদেকের সময় বক্তাবলীর চরে গানবোট ভিড়িয়ে নদীর পাড়ে নামতে থাকে পাকিস্তানি সেনারা। ঘন কুয়াশা যে কোনো কারণেই হোক তারা গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়নি। তখন মুক্তারকান্দি প্রাইমারি স্কুল, কানাইনগর হাইস্কুলসহ বক্তাবলীতে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি ক্যাম্প ছিল। নদীর পাড়ে অবস্থিত ডিক্রিরচর মসজিদ ও বিভিন্ন বাড়িতে রাত কাটাতেন মুক্তিযোদ্ধারা। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের উপস্থিতি সঙ্গে সঙ্গেই টের পেয়ে যায় এবং প্রতিরোধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। কুয়াশা একটু কাটলে কুঁড়ের পাড় অঞ্চলের নদীর কাছ থেকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে প্রথমে গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে পাকিস্তানিরা। সকাল প্রায় সাড়ে সাতটার দিকে মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। প্রায় দুই ঘন্টার প্রতিরোধ যুদ্ধে পাঁচ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। আহতও হয় বেশ কজন পাকসেনা। ৫টি লাশ ও আহত দুজনকে কাধে নিয়ে পিছু হটে পাকিস্তানি সেনারা। এই প্রতিরোধের কারণে বক্তাবলীর গ্রামগুলো থেকে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ মুন্সিগঞ্জ ও বিভিন্ন অঞ্চলে সরে যেতে পারে। এরপর পাকিস্তানি সেনা বাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে গ্রামগুলোর ওপর। পাক হানাদারদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের মুখে পিছু হটে মুক্তিবাহিনী। আর তখনই শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর তাণ্ডব। তারা ডিক্রিরচর নদীর পাড়ে ৪০ জন গ্রামবাসীকে সারিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে একসঙ্গে হত্যা করে। লক্ষ্মীনগর কবরস্থানের কাছে খড়েরপাড়ার ভেতরে আশ্রয় নেওয়া দলবদ্ধ গ্রামবাসীদের আগুন জ্বালিয়ে হত্যা করে। রাজাপুরের হলুদ সরিষা ক্ষেতে পড়ে থাকে লাশের পর লাশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শহীদুল্লাহ, মুনীরুজ্জামানসহ বহু ছাত্র আর সাধারণ কৃষককে হত্যা করে তারা। বক্তাবলীতে ১৩৯ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। বক্তাবলী পরগনার ২২টি গ্রামই গান পাউডার দিয়ে বিকেলের মধ্যে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয় ওরা। অনেককে গুলি করে হত্যার পর ধলেশ্বরী নদীতে ফেলে দেয় হানাদার বাহিনী।

বন্দর গণহত্যা

১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল ভোরে বন্দর উপজেলার সিরাজদৌল্লাহ ক্লাব মাঠে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ৫৪ জন নারি-পুরুষকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। হত্যার পর লাশগুলো গান পাউডার দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে তারা। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় বাড়িঘর।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সহকারী ও যুদ্ধকালীন সময়ে বন্দর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাজী গিয়াসউদ্দিন আহমেদ জানান, ১৯৭১ সালের ৪ঠা এপ্রিল ভোরে নৌপথে এসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিতে বন্দরে আক্রমণ চালায়। তারা বন্দর সিরাজদৌল্লাহ ক্লাব মাঠে সাধারণ ৫৪ জন নারী-পুরুষকে ধরে এনে এক সারিতে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। হত্যার পর লাশের উপর মুলি বাশের বেড়ার দিয়ে গান পাউডার দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বন্দর আমিনপুর, সোনাকান্দা ডকইয়ার্ড, র‍্যালিবাগান, সিএসডি, ইস্পাহানিসহ বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প করে। তারা স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ চালাতো। ১৫ ডিসেম্বর বিকেলে নবীগঞ্জ থেকে বন্দর স্টেশন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাঁদের যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানিরা বাংকার থেকে বেরিয়ে এসে আক্রমণ করে। ব্রাশফায়ারে মিত্র বাহিনীর ৮ ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়। ২ মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়। ওইদিন বিকেল থেকে পরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। পরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পালিয়ে যায়। পরে মুক্তিযোদ্ধারা নবীগঞ্জে ১৫ রাজাকারকে ধরে হত্যা করে।

সেদিনের ঘটনায় শহিদ হওয়া ৫৪ জনের ২৫ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এঁরা হচ্ছে, ছমিরউদ্দিন সরদার, মন্তাজ উদ্দিন মাস্টার, আলী আকবর, রেজাউল ইসলাম, বাবুল, আমির হোসেন, নায়েব আলী, আলী হোসেন, ইউসুফ আলী, সুরুজ চন্দ্র, যবুনা চন্দ্র কানু, লছমন চন্দ্র কানু, কানাই লাল কানু, গোপাল চন্দ্র, ভগবত দাস, দুগচিরন প্রসাদ, নারায়ণচন্দ্র প্রসাদ, ইন্দ্রচন্দ্র দাস, সুরেশ চন্দ্র দাস, দিগেন্দ্র চন্দ্র বর্মন, বনেল চৌধুরী, মোবারক, হারাধন মাস্টার, নারায়ণ চৌধুরী, বাদশা খান, পরেশ খান।

আদমজী নগর শিমুলপাড়া বধ্যভূমি

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার সিদ্ধিরগঞ্জের বিলুপ্ত আদমজী জুটি মিলের বিহারি ক্যাম্প ‘জম ঘর’ হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জুট মিলের পাম্প হাউজের ভেতরে নিরীহ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে নির্যাতনের ও গুলি করে হত্যার পর পানির পাম্প দিয়ে লাশ ধুয়ে নদীতে ফেলে দিতো। স্থানটি এলাকাবাসীর কাছে ‘জম ঘর’ হিসেবে পরিচিতি পায়। যুদ্ধের পর এখান থেকে মানুষের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। এছাড়া মিলের বেশ কয়েকজন শ্রমিককেও তারা হত্যা করেছে হানাদাররা। স্বাধীনতার পর এই বধ্যভূমিটির সন্ধান পাওয়া যায় বলে জানান মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ফজলুল হক।

পাকসেনারা নিরীহ সাধারণ মানুষকে হত্যা করে আদমজী জুট মিলের বিহারি ক্যাম্পের ভিতরের পুকুরে নিক্ষেপ করত। স্বাধীনতার পর এ পুকুর থেকে মানুষের হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়।

স্বাধীনতার পরেই এই বধ্যভূমিটির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। আদমজীনগর জুট মিলের বেশ কিছু শ্রমিক এখানকার একটি ডোবা থেকে অনেক নরকঙ্কাল উদ্ধার করে। পাকহানাদার বাহিনী বিভিন্ন জায়গা থেকে বাঙালিদের ধরে এনে এখানে হত্যা করতো। এছাড়া এই মিলের বেশ কয়েকজন শ্রমিককেও তারা হত্যা করেছে বলে জানা যায়।

সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইলে মেঘনা পেট্রোলিয়াম গণকবর

সদর উপজেলার সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন নিয়ন্ত্রণাধীন মেঘনা পেট্রোলিয়াম ডিপোতে (তৎকালীন এসও) গণকবর রয়েছে। একাত্তরের ২৯ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ক্যাম্প বসিয়ে সেখানে সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করতো। স্বাধীনতার পর সেখান থেকে মানুষের হাড়গোড় পাওয়া যায় বলে জানান নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ফজলুল হক। তবে সেখানে বধ্যভূমির কোনো চিহ্ন নেই।

সিদ্ধিরগঞ্জের বার্মাস্ট্যান্ড পদ্মা অয়েল বধ্যভূমি

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন পদ্মা পেট্রোলিয়াম ডিপোতে (বার্মা স্ট্যান্ড) জেটিতে মানুষদের ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দিতো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

পঞ্চবটি হরিহরপাড়া বধ্যভূমি

সদর উপজেলার ফতুল্লার পঞ্চবটিতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন যমুনা অয়েল ডিপো (তৎকালীন ন্যাশনাল অয়েল মিল) মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করে। যুদ্ধকালীন পুরো ৯ মাস নির্যাতন ও বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার করেছে তারা। নির্যাতনের পর হাত-পা বেঁধে মানুষকে বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দিতো। পচে ফুলে বহু লাশ নদীতে ভেসে উঠেছে সে সময়। বিশেষ করে এই মিলের ভেতরে একটি টিন কারখানার ভিতরে নারীদের ওপর অত্যাচার করা হতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মিলের ভেতর থেকে নারীদের নির্যাতনের বহু আলামত পাওয়া গেছে। সেসময় ন্যাশনাল অয়েল মিলটির মালিক ছিল পাকিস্তানের সবেক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ছেলে গহর আইউব। বর্তমানে মিলটির এক পাশে বধ্যভূমি লেখা সাইনবোর্ড রয়েছে। সে সময় সেখানে কি পরিমাণ মানুষ হত্যা ও নির্যাতন করা হয়েছে তার কোন পরিসংখ্যান নেই।

নিতাইগঞ্জ গণহত্যা

নারায়ণগঞ্জ শহরের আর কে দাস রোড নিতাইগঞ্জে একাত্তরের ৭ এপ্রিল পোদ্দার বাড়িতে ১৬ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

ফতুল্লার শাসনগাঁও গণকবর

ঢাকা-নারায়নগঞ্জ-মুন্সীগঞ্জ সড়কের নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার পঞ্চবটি শাসনগাও মেথর খোলায় (বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন ট্রাক টার্মিনাল) গণকবর রয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ট্রাকে করে লাশ এনে (বর্তমান ট্রাক টার্মিনালের স্থানে) মাটিতে গর্ত করে গণকবর দেওয়া হয়েছে।

ফতুল্লার জমিদার বাড়ি বধ্যভূমি

নারায়নগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার ধর্মগঞ্জ হরিহরপুর হাইস্কুল সংলগ্ন জমিদার বাড়িতে ২৯ মার্চ গুলি করে প্রণব কুমার দে ও খোকন সাহা নামের দু’জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। প্রণব কুমারের বাবা পুলিশের সেকেন্ড অফিসার ছিলেন।

বিআইডব্লিউটিএ-১ জেটি

নারায়ণগঞ্জ শহরের বিআইডব্লিউটিএ ঘাট জেটিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী লোকজনকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দিতো।

Ad Placement 1
Ad Placement 2
Islam's Group