দীর্ঘ জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের প্রার্থী হিসেবে জমিয়তে উলামা ইসলামের জেলা সভাপতি মুফতি মনির হোসেন কাসেমীর নাম চূড়ান্ত হলেও এই সিদ্ধান্তের পরপরই আসনটিতে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হয়েছে। দলীয় মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত বিএনপির একাধিক প্রভাবশালী নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় জোটের প্রার্থী কাসেমী এখন বাস্তব চ্যালেঞ্জের মুখে।
বিএনপির হাইকমান্ড জোটগত সমীকরণকে অগ্রাধিকার দিয়ে নিজ দলের একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশীকে উপেক্ষা করায় ভেতরে ভেতরে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন এবং ফতুল্লা বিএনপির সাবেক নেতা মোহাম্মদ শাহ আলম প্রকাশ্যেই জানিয়েছেন, জনগণ পাশে থাকলে তারা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তুত। যদিও শেষ পর্যন্ত কারা মাঠে নামবেন, তা এখনও নিশ্চিত নয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই আসনে বিএনপির কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে সবচেয়ে বড় চাপটি পড়বে জোটের প্রার্থী মুফতি মনির হোসেন কাসেমীর ওপর। কারণ স্থানীয়ভাবে তার নিজস্ব ভোটব্যাংক দুর্বল এবং সাধারণ ভোটারদের বড় একটি অংশের কাছে তিনি এখনও অপরিচিত। বিপরীতে সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে মাঠের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এবং স্থানীয় পর্যায়ে তাদের গ্রহণযোগ্যতা তুলনামূলক বেশি।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, তফসিল ঘোষণার আগে বিএনপি সারাদেশে একাধিক দফায় প্রার্থী ঘোষণা করলেও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে কাউকে চূড়ান্ত না করায় শুরু থেকেই ধারণা ছিল—এখানে ভিন্ন কোনো কৌশল প্রয়োগ হতে পারে। এর আগেও ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে মুফতি মনির হোসেন কাসেমীকে মনোনয়ন দিয়েছিল বিএনপি।
মনোনয়ন নিশ্চিত হওয়ার পর নারায়ণগঞ্জে ফিরেই কাসেমীকে ঘিরে শোভাযাত্রা করে জোটের নেতাকর্মীরা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড এলাকা থেকে শুরু হওয়া মোটর শোভাযাত্রায় কয়েক হাজার নেতাকর্মী অংশ নেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কাসেমী বলেন, তিনি দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঘরে ভোট চাইবেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলেও তিনি বিচলিত নন বলেও দাবি করেন।
কাসেমী বলেন, সবাইকে সাথে নিয়ে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যাবো এবং নির্বাচনী প্রচারণা চালাবো। তবে এ আসনে বিএনপির কোন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও আমি বিচলিত হবো না। তাকে স্বাগত জানিয়ে আমার প্রচারণা চালিয়ে যাবো। ধানের শীষ বা খেজুর গাছ প্রতীকের বিপরীতে কাউকেই চ্যালেঞ্জের উপযুক্ত বলে মনে করি না।
অন্যদিকে, বিএনপির একটি অংশ প্রকাশ্যে ক্ষোভ না দেখালেও ভেতরের বাস্তবতা ভিন্ন। নেতাকর্মীদের কেউ কেউ বলছেন, কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মানা ছাড়া তাদের উপায় নেই, তবে মাঠপর্যায়ে হতাশা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ফতুল্লা অঞ্চলের নেতাকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে অবহেলার অভিযোগ তুলছেন।
এই প্রেক্ষাপটে মোহাম্মদ শাহ আলম স্থানীয় রাজনীতিতে এখনও একটি শক্ত নাম। সীমানা পুননির্ধারণে সিদ্ধিরগঞ্জ বাদ পড়ায় তার অবস্থান কিছুটা বদলালেও ফতুল্লাকেন্দ্রিক এলাকায় তার নিজস্ব অনুসারী ও সাংগঠনিক শক্তি এখনো কার্যকর। ইতোমধ্যে তিনি সভা-সমাবেশ, দোয়া মাহফিল ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন।
অপরদিকে, গিয়াস উদ্দিন বক্তাবলী, ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ ও সোনারগাঁ এলাকায় নিয়মিত ঘরোয়া বৈঠক, কর্মীসভা ও সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে নিজের অবস্থান আরও দৃঢ় করছেন। বিশ্লেষকদের মতে, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে তিনি এখনো সবচেয়ে দৃশ্যমান ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তি। দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা, তৃণমূল নেটওয়ার্ক এবং বিরোধী জনভিত্তির ওপর তার নিয়ন্ত্রণ তাকে স্বতন্ত্র হলেও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত করতে পারে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কঠিন রাজনৈতিক বাস্তবতায় জেলা বিএনপির সভাপতি হিসেবে অচল হয়ে পড়া সাংগঠনিক কাঠামোকে পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষেত্রেও গিয়াস উদ্দিনের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সিদ্ধিরগঞ্জের ওয়ার্ডভিত্তিক কমিটি গঠন থেকে শুরু করে আন্দোলনমুখী কর্মসূচিতে তৃণমূলের সম্পৃক্ততা সবকিছুতেই তার নেতৃত্ব স্পষ্ট ছিল।
সব মিলিয়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন এখন বিএনপির জন্য কেবল একটি নির্বাচনী আসন নয়, বরং একটি কঠিন রাজনৈতিক পরীক্ষাক্ষেত্র। জোটের সিদ্ধান্ত, দলীয় ক্ষোভ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থিতার সম্ভাবনা এই ত্রিমুখী চাপে শেষ পর্যন্ত কার ভাগ্যে কী লেখা আছে, তা নির্ধারিত হবে ভোটের মাঠেই।


































আপনার মতামত লিখুন :