৭ বছর পূর্বে মাত্র ৭০০ টাকায় শুরু করেছিলেন বাণিজ্যিকভাবে মাশরুম চাষ। তবে নিজের মেধা আর পরিশ্রমে সেই প্রকল্পে কিছুদিনের মধ্যেই সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেন মোঃ মহিনুর জামান সাব্বির। ৭০০ টাকার সেই পুঁজি যখন একলাখ টাকায় দাড়ায় তখন আরো বড় আকারে বাণিজ্যিকভাবে মাশরুম শুরু করে ৩ মাসেই আয় করেন ১৩ লাখ টাকা। এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি সাব্বিরকে। মাশরুম চাষে নিজে যেমন উদ্যোক্তা থেকে শিল্প উদ্যোক্তা হয়েছেন তেমনি প্রশিক্ষণ দিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবেও গড়ে তুলেছেন অনেককে। মাশরুম বিক্রি করা ছাড়াও মাশরুম দিয়ে তৈরী করছেন চিপস, চানাচুর, বিস্কুট, মুড়ি, আচারসহ নানা ধরনের মুখরোচক খাদ্যপণ্য। মাশরুম চাষ প্রকল্প থেকে বর্তমানে মাসেই আয় করছেন কয়েক লাখ টাকা। সাতশ’ টাকার প্রকল্প এখন দাড়িয়েছে কোটি টাকার উপরে।
মোঃ মহিনুর জামান সাব্বির জানান, তিনি হামদর্দ বিশ^বিদ্যালয় থেকে ইউনানী বিষয়ে লেখাপড়া করেছেন। তবে ইউনানী চিকিৎসক নিজের পেশা বেছে না নিয়ে তার স্বপ্ন ছিল উদ্যোক্তা হওয়ার। মানুষের জন্য কিছু করার। যাতে তার প্রতিষ্ঠান থেকে সারাজীবন মানুষ কিছু করে জীবনধারন করতে পারে। সেই স্বপ্ন পূরণে তিনি ২০১৪ সালে খামারবাড়ি থেকে মাশরুম চাষের বিষয়ে ৩ দিনের প্রশিক্ষণ নেন। শুরুতে মাত্র ১০০ টাকায় বীজ ক্রয় করেন। তখন বীজের দামও অনেককম ছিল। তখন মাত্র ১২ টাকায় বীজ পাওয়া যেত। এরপর নিজ বাড়িতে একটি ফাঁকা কক্ষে মাশরুম চাষ শুরু করেন। কয়েক বছর বাড়িতে ক্ষুদ্র আকারে মাশরুম চাষ করতে থাকেন। ২০১৭ সালের দিকে মাত্র ৭০০ টাকা দিয়ে শুরু করেন বাণিজ্যিকভাবে মাশরুম চাষাবাদ। যা থেকে আস্তে আস্তে তিনি বর্তমানে বাংলাদেশের সব থেকে বড় মাশরুম প্রকল্পের মালিক হয়েছেন। সারাদেশে তার জানামতে তার মতো এতবড় প্রকল্প আর কারো নেই। বর্তমানে তিনি নারায়ণগঞ্জের গোগনগর ইউনিয়নের ফকিরবাড়ি এলাকায় গ্যানো ফুড এন্ড এগ্রা লিমিটেড এবং গ্যানো মাশরুম সেন্টারের স্বত্বাধিকারী।
সাব্বির জানান, ৭০০ টাকা দিয়ে শুরু করলেও ২০১৮ সালের দিকে গ্যানো মাশরুম সেন্টারের পুঁজি দাড়িয়েছিল এক লাখ। তখন আরো বড় আকারে মাশরুম চাষাবাদ শুরু করলে ৩ মাসের ব্যবধানে তিনি ১৩ লাখ টাকা আয় করেন। এরপর আরো বড় পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেন। মাশরুম চাষাবাদে উদ্যোক্তা তৈরীর জন্য রাজধানী ঢাকায় মাশরুম চাষাবাদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। তার প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থী ছিল ৩৭ জন। এরপর প্রশিক্ষণার্থীরা যখন তার কাছ থেকে মাদার কালচার, বীজ ক্রয় করতে শুরু করলো সেখান থেকেও তিনি আয় করতে শুরু করলেন। বীজ সবাই উৎপাদন করতে পারেনা। কারণ বীজ উৎপাদন করতে হলে জায়গা লাগে। যারা বাড়িতে কিংবা ছোট পরিসরে মাশরুমের চাষ করেন তারা আমাদের কাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করে নিয়ে যান। এভাবে মাশরুমের প্রকল্প থেকে কোন মাসে ৩ লাখ থেকে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত আবার কোন মাসে ২ লাখ টাকা আয় করছেন। গড়ে প্রতি মাসে আয় হচ্ছে ৩ লাখ টাকার মতো। খামারবাড়ির সামনে, ধানমন্ডি লেকের পাড়ে ও হাতিরঝিল এলাকায় অফিস থেকে মাশরুম বিক্রি হচ্ছে। ইউটিউব ও ফেসবুকে দেখে অনেকেই তাদের প্রতিষ্ঠানে এসে মাশরুম কিনে নিয়ে যান। রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় ১৫টি দোকান রয়েছে যারা মাশরুমের চপ বিক্রি করে। সেখানে প্রতিটি দোকানে ৫ কেজি করে মাশরুম লাগে। মাশরুম চাষের মাধ্যমে তিনি সারাদেশেই গড়ে তুলেছেন অসংখ্য খামার। নিজের মালিকানাধীন ১৭টি খামার রয়েছে যেগুলো আকারো ৪-৫ বিঘা জমির উপরে প্রতিষ্ঠিত। যার মধ্যে দিনাজপুরে ৩০ বিঘার উপরে একটি খামার করেছিলেন। কিন্তু সেখান থেকে কাাঁচা মাশরুম ঢাকায় আনতে সমস্যা হওয়ায় সেটি কমিয়ে ১২-১৩ বিঘার মধ্যে প্রকল্পের কাজ চলছে। এছাড়া হালুয়াঘাটে ২ বিঘার উপরে একটি মাশরুম প্রকল্প, মুন্সিগঞ্জে, ঢাকা, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে। তার পরিকল্পনা ছিল সারাদেশেই গ্যানো মাশরুম সেন্টার করার।
সাব্বির আরো জানান, তিনি শুধু কাঁচা মাশরুম বিক্রিতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি চলতি বছরের শুরুর দিকে গ্যানো ফুড এন্ড এগ্রো লিমিটেড নামে মাশরুমের ফুড প্রডাক্ট তৈরীর শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। বিএসটিআইয়ের কাছ থেকে মাশরুম নামে ১২টি ফুড প্রডাক্টের অনুমতি নিয়েছেন। যার মধ্যে ৫টি ইতোমধ্যে রানিং রয়েছে। এর মধ্যে চিপস, ঝালমুড়ি ও চানাচুর বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করছেন। আগামী সপ্তাহে বিস্কুট তৈরী শুরু করবেন। এছাড়াও রয়েছে আচার ও চাটনী। যার মধ্যে আচার থাকবে ২০ ধরনের। বর্তমানে মাশরুম ব্র্যান্ডের উৎপাদিত চিপস, চানাচুর ও মুড়ি রাজধানী ঢাকা, খুলনা, চুয়াডাঙ্গা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় বাজারজাত হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমি ছোট উদ্যোক্তা হিসেবে শুরু করলেও বর্তমানে কোটি টাকার উপরে ব্যালেন্স দাড়িয়েছে। তাই ছোট উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে বলবো তাদেরকে লেগে থাকতে হবে। আমার স্বপ্ন প্রতিষ্ঠানকে আরো বড় করার। যাতে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান হতে পারে। বর্তমানে সারা বাংলাদেশ জুড়ে তার সাড়ে ৩শ’ জন কর্মচারী কাজ করছে। ২০২৫ সালে তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে ৩ থেকে ৪ হাজার কর্মরত থাকবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তিনি উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, চাকরীর পেছনে না ঘুরে যেকোন বিষয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা নিয়ে লেগে থাকলে তার স্বপ্ন ইনশাল্লাহ একদিন বাস্তবায়ন হবে।
প্রতিষ্ঠানে কর্মচারীরা জানান, তারা এই মাশরুম প্রকল্পে কাজ করে আগের চেয়ে অনেক ভাল অবস্থানে রয়েছেন। তাদের আয়ও বেড়েছে। অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এছাড়া এখানে উৎপাদিত মাশরুম তারা নিজেরাও খেয়ে উপকৃত হয়েছেন। মাশরুম দিয়ে নানা ধরনের খাদ্য সামগ্রী তৈরী করা হচ্ছে। এক বিক্রেতা বলেন, মাশরুমের মিশ্রণ দিয়ে তৈরী চিপস, চানাচুর ও মুড়ি প্রতিদিনই তারা বিক্রি করছেন। ভোক্তারাও এসব পণ্য খেয়ে উপকৃত হচ্ছেন। ভোক্তারা বলেন, মাশরুম ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগের জন্য অনেক উপকারী। মাশরুম শরীরে পুষ্টির চাহিদাও পূরণ করে। মাশরুমের পণ্য খেয়ে তারা উপকৃত হয়েছেন।
আপনার মতামত লিখুন :