৯০ এর দশকে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে ক্যাডার ভিত্তিক প্রচলন খুব জনপ্রিয় ছিল। তখন নেতার চেয়ে ক্যাডারদের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। কারণ ওই সময়টাতে রাজনীতিতে যার যত অস্ত্র আর বাহিনী তার তত কদর ছিল। শহরের চাষাঢ়া আর মিশনপাড়ার মধ্যে যুদ্ধ ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। কখনো আওয়ামী লীগ আক্রমন করতে মিশনপাড়া আবার কখনো চাষাঢ়া আক্রমণ করতো বিএনপি। তখনকার সময়ে ডেভিড ছিল অপরিহার্য। এ ডেভিডকে দিয়েই একসময়ে নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগকে প্রতিহত করতো বিএনপি-শহরে এমন খবর চাউর রয়েছে অনেক আগে থেকেই। বিশেষ করে ১৯৯৬ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে নারায়ণগঞ্জ শহরে রাজনৈতিক সংঘর্ষের বেশীরভাগ সময়ে বিএনপির নেতৃত্বে ছিলেন ডেভিড। দলের অনেক নেতাদের অভিযোগ, ডেভিড থাকলে নারায়ণগঞ্জ বিএনপি অনেক চাঙ্গা থাকতো।
ভালো ক্রিকেট খেলতেন নারায়ণগঞ্জের মমিনউল্লাহ ডেভিড। ছিলেন শহর যুবদল নেতা। রাজনীতির পথে হাঁটতে গিয়ে ক্রিকেট ব্যাট ছেড়ে হাতে তুলে নেন অবৈধ অস্ত্র। পুলিশও তার কাছ থেকে রেহাই পায়নি। পুলিশকে মারধর ও গুলি ছিনিয়ে নেওয়ারও ঘটনা ঘটান এই ডেভিড। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি চলে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। কোনোভাবেই তার লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছিল না। অবশেষে দল ক্ষমতায় থাকতেই র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হন ডেভিড। পুলিশের হিসাবে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন থানায় খুন, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, হামলাসহ ডেভিডের বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা ছিল।
২০০৪ সালের ২৪ নভেম্বর রাতে ঢাকার মালিবাগ কমিউনিটি সেন্টারে সামনে ডেভিড গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন তথা র্যাবের দাবি ছিল, তাদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের এক পর্যায়ে ক্রসফায়ারে পড়ে ডেভিডের মৃত্যু ঘটে।
ডেভিডের পরিবার : ডেভিডের বাবার নাম বশিরউল্লাহ। সে এক সময়ে আদমজীতে চাকরি করতো। তার ৭ ছেলে ও ২ মেয়ে। তার মধ্যে ৩ জন মারা গেছে। তারা হলো কিরণ, মমিনউল্লাহ ডেভিড ও মনা। বেঁচে রয়েছে মাহবুব উল্লাহ তপন, রিপন, শাহাদাতউল্লাহ জুয়েল, রোমান।
অপর ভাই শাহাদাতউল্লা জুয়েল বর্তমানে কারাবন্দী। ২০০৭ সালের ২৭ নভেম্বর শহরের মিশনপাড়ার বাসভবন থেকে জুয়েলকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-১১। জুয়েলের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ কার্যালয়ের সামনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার মামলায় তিনি সাজাপ্রাপ্ত। এছাড়া ২০০১ সালের ১৬ জুন শহরের চাষাঢ়ায় আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলার মামলায় তাকে অভিযুক্ত করে চার্জশীট দেওয়া হয়েছে।
মমিনউল্লাহ থেকে ডেভিড : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯১ হতে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়া ও মিশনপাড়া এলাকার মধ্যে প্রায় সময়েই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটতো। চাষাঢ়ায় এলাকায় ছিল আওয়ামী লীগের লোকজনদের আধিপত্য। আর মিশনপাড়া এলাকার বাসিন্দা ডেভিড স্থানীয় বিএনপি ক্যাডারদের নেতৃত্ব দিত। তখন থেকেই আলোচনায় আসে ডেভিড। সে সময়ে ডেভিড অনেক অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করলেও তার কোনটিই এখন পর্যন্ত উদ্ধার করা যায়নি। ১৯৯৬ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে অনেক বন্দুকযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে ডেভিড স্থানীয় বিএনপি নেতাদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়। ওই বছরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে পালিয়ে যায় ডেভিড। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ডেভিড আবারো এলাকাতে ফিরে আসে। তখন তাকে শহরের মিশনপাড়া এলাকায় দেওয়া হয় সংবর্ধনা। এতে এলাকার বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাগম ঘটে। অভিযোগ রয়েছে, সে সময়ে সরকারের এক প্রতিমন্ত্রী এমপি ডেভিডকে ব্যবহার করতো।
তখনকার এমপিদের দ্বারা ব্যবহৃত : জানা গেছে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকা সময়ে ২০০৪ সালের ২৪ নভেম্বর ডেভিডের মৃত্যুর ঘটনার পেছনে দলের শীর্ষ নেতাদের ব্যর্থতা আর ‘ব্যবহৃত’ রাজনীতিকেই দায়ী করা হয়েছিল। নারায়ণগঞ্জে গত দুই দশকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্রসফায়ারে অন্তত দেড়ডজন রাজনীতিক। কিন্তু তাদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল সাবেক যুবদল নেতা মমিনউল্লাহ ডেভিডের ক্রসফায়ারটি।
২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর এ ডেভিডকে নিয়ে সংসদে কঠোর সমালোচনা করেছিল তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের এমপিরা। বহুল সমালোচিত ডেভিডকে কব্জা করতে সে সময়ের নারায়ণগঞ্জের বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে ছিল নীরব যুদ্ধ। তবে এও অভিযোগ রয়েছে, বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরোধের কারণেই ডেভিডকে প্রাণ হারাতে হয়েছিল।
২০০১ হতে ২০০৬ সাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের ৫টি আসনের এমপি ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৫ এ আবুল কালাম, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে গিয়াসউদ্দিন, নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে রেজাউল করিম, নারায়ণগঞ্জ-২ আসনে আতাউর রহমান খান আঙ্গুর ও নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে আবদুল মতিন চৌধুরী।
তাদের মধ্যে রেজাউল করিম ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই সময়ে রেজাউল করিম মূলত ডেভিডকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করেছিল এমন অভিযোগ ছিল।
ঘটনার দিন
২৪ নভেম্বর ড্রেজারের একটি টেন্ডারের সিডিউল জমা নেওয়া হয়। ডেভিডের অনুগতরা সিডিউল জমা দেয় দুপুর ১২টায়। এর পর সে মোটা অঙ্কের টাকা প্রদানের জন্য এক এমপির কাছে যায়। সেখানে টাকা দিয়ে রাতে ঢাকায় যাওয়ার সময়ে মালিবাগ এলাকায় র্যাবের কথিত ক্রসফায়ারে ডেভিডের মৃত্যু ঘটে। তার মৃত্যুর পর শহরের মিশনপাড়া এলাকায় জানাযা অনুষ্ঠিত হলেও তাতে জনরোষের ভয়ে উপস্থিত হতে পারেনি এমপি।








































আপনার মতামত লিখুন :