মায়ের অসুস্থতা আর পরিবারের দু:খ কষ্টের ভার কাঁধে নিয়ে কৈশোরেই থেমে গিয়েছিল শ্রী শুভ চন্দ্র দাসের পড়াশোনা। শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন তখনই ভেঙে যায়। কিন্তু স্বপ্ন ভেঙে গেলেও তা হারিয়ে যায়নি বরং অন্য রূপ নিয়েছে। নিজের স্বপ্ন পূরণ হয়নি, তাই তিনি পথশিশুদের চোখে নতুন স্বপ্ন বুনতে শুরু করেন। গত নয় বছর ধরে নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়া রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মের শেষপ্রান্তে খোলা আকাশের নিচেই চলছে সেই স্বপ্নযাত্রা। এখানে ছোট ছোট ছিন্নমূল শিশুদের নিয়ে গড়ে উঠেছে ব্যতিক্রম এক পাঠশালা যার নাম “লাল সবুজের পতাকা শ্রী শুভ চন্দ্র প্রাথমিক শিশু বিদ্যালয়”।
শুক্রবার বাদে প্রতিদিন বিকেল চারটার পর শুরু হয় পড়াশোনা। জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত আর শপথ বাক্য পাঠের মধ্য দিয়েই শুরু হয় দিনের শিক্ষা কার্যক্রম। এরপর সাদা বোর্ডে চক দিয়ে লিখে বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি শেখান শুভ চন্দ্র। ছোট্ট এক টংঘরের ভেতরে রাখা থাকে শিক্ষা সামগ্রী, আর কয়েকটি বেঞ্চে বসে মনোযোগ দিয়ে শোনে শিশুরা। শিশুদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য বিদ্যালয় থেকে নাস্তা সরবরাহ করা হয়ে থাকে। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়েই স্কুলটি পরিচালিত হয়ে আসছে।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১১ মার্চ এই স্কুলের পথচলা শুরু হয়। শহরের একটি গার্মেন্টসে চাকরি করে উপার্জিত টাকায় প্রথমে বোর্ড, আদর্শলিপি আর বসার পার্টি কিনেছিলেন তিনি। প্রথমে রাজি হয়েছিল মাত্র ১১ জন পথশিশু। আজ সেই সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫-এ। শুধু তাই নয় এই স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কয়েকজন এরই মধ্যে বিভিন্ন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। কেউ পড়ছে নবম শ্রেণিতে কেউ বা দশমে। শুভর কাছে সেটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য। যদিও স্কুলটি এখনো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়নি। মাথার উপর খোলা আকাশ, বৃষ্টিতে ভিজে কিংবা ঝড়ো হাওয়ায় পড়াশোনা করাই তাদের নিয়মিত বাস্তবতা।
অভিভাবকেরা জানান, “এই স্কুল শুধু শিশুদের নয়, অভিভাবকদের কাছেও এক আশ্রয়ের জায়গা। বিদ্যালয়ে কোনো টাকা লাগে না। তাই বিনা খরচে তাদের সন্তানরা পড়াশোনার সুযোগ পাওয়ায় ভীষণ খুশি তারা।
এদিকে পাঠশালাটি দেখে অনেক পথচারী থমকে যাচ্ছেন। রেল স্টেশনের মতো জায়গায় এমন স্কুল? অবাক হচ্ছেন অনেকেই। একাধিক পথচারী জানান, “এমন স্কুল তারা আর কোথাও দেখে নাই। এটা আসলেই পথশিশুদের জন্য আশীর্বাদ। এখনো দেশে এমন ভালো মানুষ আছে দেখে ভালো লাগছে, যারা শিশুদের জন্য কিছু করতে চান।”
স্থানীয়রা জানান, শুভ চন্দ্র দাসের মতো এক তরুণের উদ্যোগেই এখন পথশিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে। তারা প্রশাসন ও বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
স্কুলটির একমাত্র শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠাতা শ্রী শুভ চন্দ্র দাস বলেন, “ছোটবেলা থেকে ভাবতাম শিক্ষক হবো। কিন্তু মা-বাবা দুজনকেই হারিয়েছি, অভাব-অনটনের কারণে লেখাপড়াও বেশি দূর করা হয়নি। তাই মনে হলো, আমি না পারলেও অন্যদের শিক্ষক হয়ে স্বপ্ন দেখাতে পারি।”
তিনি আরও বলেন, “বিভিন্ন সময় সরকারি তোলারাম কলেজ ও সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা এসে এখানে পড়িয়েছে, সাহায্য করেছে লায়ন্স ক্লাব, রোটারি ক্লাবসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনও। কিন্তু এখনো বিদ্যালয়টির কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই। বিদ্যালয় নিয়ে আমার স্বপ্ন একটাই এই বিদ্যালয়টি একটি স্থায়ী রূপ লাভ করুক। তাহলে শিক্ষার্থীদের আর কষ্ট করতে হবে না। আর পড়াশোনাও সুন্দরভাবে চালাতে পারবো।”






































আপনার মতামত লিখুন :