‘‘গত ৬ মাস যাবত অ্যালার্জি রোগে ভুগছি। বেশ কয়েকবার ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খেলেও রোগ ভালো হচ্ছে না। আমার ধারণা করোনা ভাইরাসের টিকা নেওয়ার ফলে এই রোগে আক্রান্ত হয়েছি।’’ অভিযোগ তুলেন মো. ইমন নামের এক যুবক। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) ১নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা এই যুবক বলেন, আমি ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল থেকে ফাইজারের তিনটা টিকা দিয়েছিলাম। এরপর থেকে আমি অ্যালার্জির সমস্যা পড়ি। শুধু আমিই না আমার মা-বাবা ও স্ত্রীও একই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত অন্তত ১০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে এই রোগের পেছনে। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে এখনো ভালো হয়নি। আমরা রোগ থেকে মুক্তি পেতে ডার্মাসল ব্যবহারের পাশাপাশি আরও বেশ কয়েকটি ওষুধ খেয়েছি। আমাদের এলাকায় পিজি হাসপাতালের নাজমুল নামক এক ডাক্তার বসেন,তাকে দেখানোর পর তিনি আমাকে বলেছে যে এই রোগটা ছোঁয়াচে রোগ। অর্থাৎ পরিবারের একজনের হলে অন্যরাও আক্রান্ত হয়ে যায়।
শুধু ইমনই নয় এমন অন্তত ৮ জন অ্যালার্জি রোগীর সঙ্গে কথা বলেছে নিউজ নারায়ণগঞ্জ। এই রোগে আক্রান্ত প্রত্যেকের অভিযোগ করোনার ভ্যাকসিন নেওয়ার পর হতে এমনটা হয়েছে।
তবে রোগীদের অভিযোগের বিষয়ে চর্ম ও মেডিসিন রোগ বিশেষজ্ঞ ও নারায়ণগঞ্জ সিভিল সার্জনের ভাষ্য করোনার ভ্যাকসিনের সঙ্গে অ্যালার্জির কোনো সম্পর্ক নেই। এটা ভুল ধারণা।
এদিকে সিদ্ধিরগঞ্জের পাইকারি ও খুচরা ওষুধের দোকানগুলোতে ডায়াবেটিক, গ্যাস্টিকের পাশাপাশি অ্যালার্জির ওষুধের বিক্রি কয়েকগুণ বেড়েছে বলে দোকানিরা জানিয়েছেন। অনেক দোকানি বলেছে অ্যালার্জির ওষুধ চাহিদা মতো পাওয়া যাচ্ছে না।
রোগে আক্রান্ত রোগীরা যা বলেছেন : রূপগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা মো. ইউসুফ চিটাগাংরোড চাকরি করেন। তিনি গত একবছর ধরে অ্যালার্জিতে ভুগছেন। একেরপর এক প্রফেসর ডাক্তারের পরামর্শে এখন পর্যন্ত অন্তত ২০ হাজার টাকার বেশি ওষুধ খেয়েছেন। তবে রোগ হতে মুক্তি মেলেনি। তিনি বলেন, আমি ফাইজারের তিনটা টিকা নিয়েছিলাম এরপর থেকে এই সমস্যা হয়েছে। করোনার টিকাকে সন্দেহ করার অন্যতম কারণ হচ্ছে আমার পরিচিত বহু মানুষেরও এই রোগ হয়েছে এবং তারাও একই কথা বলেছে। সেজন্য আমি এই বিষয়টা নিশ্চিত হতে ঢাকার
ফরাজি হাসপাতালের চিকিৎসকসহ তিনজনকে জিজ্ঞেসও করেছি, কিন্তু তারা এটা সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য দেয়নি। ডাক্তাররা বলেছে রোগ বিভিন্ন কারণে হতে পারে সেটা টিকা কিংবা অন্যান্য কারণেও।
সিপন আহমেদ নামের মিজমিজির এক ব্যবসায়ীসহ তার পরিবারের পাঁচ সদস্যই অ্যালার্জিজনিত রোগে আক্রান্ত ছিল। এক বছরের চিকিৎসার একপর্যায়ে গত দুইমাস আগে তারা সুস্থ হয়েছেন। সিপন আহমেদ নিউজ নারায়ণগঞ্জকে বলেন, আমি আর আমার স্ত্রী ফাইজার টিকা নিয়েছিলাম। এই রোগ হবার পর আমাদের শরীর থেকে পরিবারের অন্য সদস্যদের শরীরেও ছড়িয়ে যান। আমি চিকিৎসকের পরামর্শে ইলিমেট প্লাস, ক্রোনিক্স লোশন ও ওফ্লাসিন ২০০ এম.জি ট্যাবলেট খেয়ে বর্তমানে সুস্থ রয়েছি।
মায়ের অ্যালার্জি রোগের ওষুধ নিতে দোকানে এসেছেন তরুণী সাথী। তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলে তিনি বলেছেন, আমার মা সাত মাস ধরে এই রোগে আক্রান্ত। তার পেছনে এখন পর্যন্ত ৭-৮ হাজার টাকা শেষ হয়েছে। এখন শুধু তিনিই নন আমার নানুও আক্রান্ত হয়েছে। মূলত করোনার ভ্যাকসিন থেকে এই রোগ হয়েছে বলে আমরা ধারণা করি। কারণ আমার পরিচিত অনেকেরই এই সমস্যা দেখেছি। আবার এটা বিশ্বাসের অন্যতম প্রমাণ হচ্ছে আমি টিকা নেইনি এবং আমার রোগও হয়নি।
শরিফুল ইসলাম তনয়ও একই রোগের রোগী। এই যুবক বলেছেন, আমার অ্যালার্জি সমস্যা মারাত্মকভাবে ভোগাচ্ছে। আমি বার্ডেমের এক প্রফেসরকে দেখিয়ে ওষুধ খেয়ে যাচ্ছি। আমার ব্যক্তিগত ধারণা এই রোগ করোনার ভ্যাকসিন থেকে হয়েছে। বর্তমানে অ্যালসেট ও অ্যালিস ট্যাবলেটের পাশাপাশি পেরোজা ও বেটামেসন ক্রীম ব্যবহার করছি।
নারায়ণগঞ্জ কলেজের শিক্ষার্থী সানজিদা আক্তার শোভা ও তার মা আড়াই মাস ধরে ওষুধ খাচ্ছেন। শোভার অভিযোগ করোনার টিকার সাইড এফেক্ট হয়ে অ্যালার্জি হয়েছে। তারা শরীরে ক্রীম ব্যবহার করছে বলে জানান।
আইরিন নামের ২নং ঢাকেশ্বরী এলাকার গৃহবধূ সিদ্ধিরগঞ্জপুল এলাকার ফার্মেসীতে ওষুধের খোঁজে এসেছেন। তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে তিনি ও ভ্যাকসিনের অভিযোগ তোলেন। বলেন, দুই মাস ধরে সন্তানসহ আমিও ভুগছি। ট্যাবলেট বাসায় রয়েছে কিন্তু লোরিক্স ক্রীম শেষ হওয়ায় কিনতে এসেছি। মানুষজন বলে করোনার টিকা থেকে এই রোগ হয়েছে। এখন আমারও তাই মনে হচ্ছে।
শপিংমলে চাকরি করেন নিলয় নামের এক তরুণ। সেও তিন মাস ধরে অ্যালার্জি রোগে আক্রান্ত। তার ভাষ্য পুরো শরীরে ছোটছোট গোটা উঠায় প্রচন্ড চুলকানি হয়। এই তরুণ প্রথমবার আক্রান্ত হয়ে ওষুধ খেয়ে সুস্থ হলেও সম্প্রতি ফের হয়েছে।
খুচরা ও পাইকারি দোকানিদের বক্তব্য : চিটাগাংরোডস্থ অপি ফার্মেসীর পাইকার ব্যবসায়ী সেলিম বলেন, আমাদের এখানে স্কোয়ারের ওষুধের বেশি চাহিদা। বর্তমানে চর্ম রোগের ওষুধ পাওয়াটাও কষ্টকর। আমরা পাইকারি ব্যবসা করায় তেমন তথ্য দেওয়া সম্ভব না যা খুচরা দোকানরা দিতে পারবে। তবে বর্তমানে আমাদের চর্ম রোগের ওষুধের চাহিদা বেশি রয়েছে।
কি কি নামের ওষুধ বেশি চলে জানতে চাইলে তিনি বলে, অনেক নামের রয়েছে যেমন: অ্যালার্ট,রুপা ট্যাবলেট ও ফানজিডাল লোশনসহ বহু পদের।
ভুঁইয়া নামক পাইকারী ফার্মেসীর কর্মচার সালাউদ্দিন বলেন, ডায়বোটিক গ্যাস্টিকের সাথে বর্তমানে অ্যালার্জি রোগীদের ওষুধের চাহিদা অনেক বেশি। যেমন অধিকাংশ রোগী টারবিকিল, আরুবিন, ভরি, ব্রিটাম এসব ওষুধ বেশি ক্রয় করেন। আমাদের দোকানে এই রোগের ওষুধই বর্তমানে বেশি।
বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য : আমেরিকান একটি এনজিওতে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত মেডিসিন ডাক্তার নাজমুল। তার ভাষ্য, চর্ম রোগটা উচ্চমাত্রার ছোঁয়াচে রোগ। যেকোনো পরিবারের একজনের হলে অন্যদের অতি তাড়াতাড়ি আক্রান্ত করে। তারপর এলাকার পানিজনিত সমস্যাসহ নানা কারণে হয়। করোনার ভ্যাকসিনের কারণে এটা হচ্ছে মানুষ অভিযোগ করছে, তবে এর কোনো প্রমাণ মেলনি।
রোগীদের অভিযোগের যুক্তি সম্পর্কে জানতে ইউএস বাংলা মেডিকেল কলেজের বিভাগীয় প্রধান ও চর্ম রোগ বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ রাশেদুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তার মতে, করোনার ভ্যাকসিনের ফলে এলার্জি রোগ হচ্ছে এটা প্রচলিত ভাষা। মানুষের বলার বলা কথাও এটি।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, স্ক্যাবিস রোগ নিয়ে যে অভিযোগটা তোলা হচ্ছে এটা ছোঁয়াচে রোগ। যার প্রকোপ করোনা ভ্যাকসিনের আগেও ছিল। মূল কথা হচ্ছে স্ক্যাবিস রোগের জন্যে যেসব ওষুধ আবিস্কৃত হয় সেগুলো আমাদের দেশেও রয়েছে। তবে প্রতিটা রোগোর ওষুধের সময়ের একটা প্যাটার্ন থাকে যা চেঞ্জ হয়ে থাকে। যেমন ২০-৩০ বছর পর নতুন ওষুধ আবিস্কৃত না থাকলে আগেরগুলার কার্য ক্ষমতা কমে যায়। আর এই স্ক্যাবিস রোগটা বেশ পুরানো যেমন ১৭-১৮০০ সালে এটা দেখা গেছে এবং ঠিক ওইসময়ে ওষুধটা ভালো কাজ করতো। তবে সময়ের ব্যবধানে আর ওষুধগুলো যত্রতত্র ব্যবহারের কারণে এখন কাজটা কম করছে। এই রোগটা মেডিসিনের খাবার মাধ্যমে সেরে গেলেও আবার পুনরায় আক্রান্ত হয় মানুষ। মূল কথা হচ্ছে ভ্যাকসিনের সঙ্গে এটার কোনো সম্পর্কে নেই।
নারায়ণগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন ডা এএফএম মুশিউর রহমান বলেন, করোনা ভ্যাকসিনের কারণে অ্যালার্জি রোগ হচ্ছে এটা একেবারে প্রোপাগান্ডা। কারণ এটা কোনো বৈজ্ঞানিক পরিক্ষা-নিরিক্ষায় প্রমাণ পাননি। যেকোনো ওষুধের রিয়াকশন হলে তা তাৎক্ষণিক অর্থাৎ ১০ মিনিট থেকে ১০ ঘন্টার মধ্যে হয়, এর বেশিক্ষণ সমস্যা হয়না। সেক্ষেত্রে ভ্যাকসিনের ৩-৪ বছর পর এটাতে সমস্যা হবে এটা একেবারে ভুল ধারণা।
তিনি বলে, খেয়াল করে দেখবেন করোনা জনিত কারণে পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশে মৃত্যুর হার অনেক কম এর কারণ হচ্ছে সরকার সবাইকে ভ্যাসকিন দেওয়াতে নিশ্চিত করেছিল। ইউরোপীয় দেশগুলোতে সমানে আইসিইউ রয়েছে সেসব দেশেও মানুষ পড়ে পড়ে মরে ছিল। সেক্ষেত্রে এটা প্রোপাগান্ডা। অ্যালার্জি হবার মূল কারণ হচ্ছে পরিবেশগত দূষণ প্রচন্ড বেড়েছে। যেমন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বায়ু দূষণ পৃথিবীর ৩-৪ দেশের মধ্যে একটা। তারপর করোনাকালীন সময়ে আমরা মাক্স ব্যবহার করলেও এখন করছি না,পানির অভাব, যত্রযত্র ফাঁসফুড খাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে।








































আপনার মতামত লিখুন :