এক সময়ে জুয়ার আড্ডার জন্য আলোচনায় ছিল নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার পঞ্চবটিতে অবস্থিত ‘দ্য ইউনাইটেড অ্যাসোসিয়েশন (ইউনাইটেড ক্লাব হিসেবে পরিচিত)। তবে এবার এ ক্লাবটিতে মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তোলা হয়েছে। রোববার (১৪ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় জামায়াত নেতা মাওলানা মাঈনউদ্দিন আহমদ ইউনাইটেড ক্লাব নিয়ে কথা বলেন।
তিনি অভিযোগ তুলেন, নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন অলিগলিতে মাদকের সয়লাব হয়ে গেছে। এই মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার ব্যাপারে জোরদার করা হয়। কেউ কেউ বলেন, নারায়ণগঞ্জে অর্ধেকের বেশি মাদক সরবরাহ হয়ে থাকে নারায়ণগঞ্জ ক্লাব ও ইউনাইটেড ক্লাব থেকে। এই সরবরাহ বন্ধ করার জন্য জোর দাবী করা হয়। পাশাপাশি প্রশাসনের নজরদারি জোরদার করার উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়।
২০১৯ সালের অক্টোবরে ওই সময়কার পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ থাকাকালে এ ক্লাবে অভিযান চালিয়ে তখনকার সভাপতি সহ ৭ জুয়ারিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর পর থেকেই আলোচনায় উঠে এসেছে ক্লাবটি।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, ১৯৫৩ সালে ক্লাবটি প্রতিষ্ঠান করেন স্থানীয় স্বনামধন্য ও সমাজসেবক মো. মকবুল হোসেন। ক্লাবটি তিনি সমাজ সেবা ও সামজ উন্নয়নের মানুষের পাশে কাজ করার জন্য গঠন করেন। এর ধারাবাহিকতায় একটি পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি সঙ্গবদ্ধ ভাবে শীষমহল এলাকা সহ ফতুল্লার আশে পাশের বিভিন্ন এলাকার অসহায় মানুষের সেবায় কাজ শুরু করেন। এর ধারবাহিকতায় এলাকার রাস্তা, সমস্যা সমাধান, চাহিদা পূরণে কাজ করে যাচ্ছিল। পরবর্তীতে ধারাবাহিকতায় আসেন অনেকে।
এর মধ্যে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি (১৯৫৩-৫৫, ৫৮-১৯৬০) মো. মকবুল হোসেন , প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক (১৯৫৩-১৯৫৫) জহীর উদ্দিন আহ্মদ, সভাপতি (১৯৬১-১৯৬২) এটিএম লেহাজ আলী তালুকদার, সভাপতি (১৯৬৪-১৯৬৬) মো. সিরাজ উদ্দিন আহাম্মদ, সভাপতি (১৯৮৭-১৯৮৯) আব্দুল মজিদ মিয়া, সভাপতি (১৯৭২-৭৪, ৯০-৯৪, ৯৯-২০০০) মো. সামছুল হক।
শীষমহল এলাকার বাসিন্দারা বলেন, ক্লাবটি প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই ২০০০ সাল পর্যন্ত জনসেবায় ছিল। কিন্তু যখন থেকে নতুন সদস্য ও সভাপতিরা আসতে শুরু করছেন তখন থেকে এটা জনসেবা মূলক ক্লাব থেকে এলিট শ্রেনির ক্লাবে পরিণত হয়। যেখানে সাধারণ মানুষের আনাগোনা বেশি হতো এখন সেটা নিয়ন্ত্রাণাধীন। ক্লাবের এলিট শ্রেনির সদস্যরা ছাড়া আর কেউ সেখানে প্রবেশ করতে পারেন না। প্রবেশ করাতো দূরের কথা ক্লাবের সদস্য ছাড়া কেউ গেইটের বাইরেও দাঁড়াতে পারেন না। কেউ গেলেই তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।
একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ‘‘বাইরে থেকে যতটা আভিজাত্য ফুটে না উঠে ভেতরে প্রবেশ করলে চোখ ভড়কে যাওয়ার অবস্থা হবে। প্রতিটি কক্ষ সুসজ্জিত। সেগুন কাঠের নান্দনিক ইন্টেরিয়র ডিজাইন প্রত্যেকটি রুমে। আছে ভিআইপি কক্ষও। প্রবেশ করতে হয় কার্ড পান্স করে। ভিআইটি রুমে আছে একাধিক এয়ার কন্ডিশনার, বিশার আকৃতির টিভি, ফ্রিজ থেকে শুরু করে যাবতীয় সকল আয়োজন। তাস খেলার জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা আছে টেবিল। আছে বিলিয়ার্ড বোর্ডও।’’
এছাড়া হাসনাহেনা, জবা, গোলাপ সহ বিভিন্ন ফুলের নামে কয়েকটি কক্ষ রয়েছে। এসব কক্ষের নাম নিয়ে আগুন্তকদের মাঝে বেশ কৌতুহল রয়েছে। তবে এ কক্ষগুলোতে কোন ধরনের অনৈতিক কর্মকাÐ চলে কিনা তা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে।
অভিযান চালানো ডিবির কর্মকর্তারা জানান, ক্লাবের ভেতরে কয়েকটি ভিআইপি রুম আছে। সেখানে সকলের প্রবেশ করতে নিষেধাজ্ঞা আছে। বিশেষ কার্ড পান্স করেই ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। রাতে ক্লাবের মূল ফটক তালা মারা থাকে। নিচতলায় কমিউনিটি সেন্টার আছে। সেখানে বিয়ের অনুষ্ঠানের বুকিং দেওয়ার কথা বলে ডিবি কর্মকর্তারা ভেতরে প্রবেশ করে।
অভিযানে ক্লাবের ওই সময়কার সভাপতি ফতুল্লার ধর্মগঞ্জ এলাকার মৃত আব্দুল মজিদ মিয়ার ছেলে তোফাজ্জল হোসেন তাপু (৫৫), মৃত এম এ কুদ্দুসের ছেলে ইকবাল হোসেন (৫৬), আবুল হাসেমের ছেলে কামাল হোসেন (৪৯), আজমেরীবাগ এলাকার মৃত আব্দুল হাইয়ের ছেলে শামসুজ্জামান (৪০), চাষাঢ়ার মার্ক টাওয়ার এলাকার মৃত আব্দুল জব্বারের ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান (৫২), পঞ্চবটির মৃত ওবায়দুল হক ভূইয়ার ছেলে এবিএম শফিকুল ইসলাম (৫০), ঢাকার কেরানীগঞ্জের কাজিরগাঁও এলাকার মৃত আব্দুল মালেকের ছেলে আফজাল হোসেনকে (৪০) গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্লাবে নতুন নেতৃত্ব আসলেও মূলত তোফাজ্জল হোসেন তাপু এখনো নিয়ন্ত্রন করে আসছেন। গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হওয়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ) সংসদীয় এলাকার অনেক নেতাকর্মীই দল পরিবর্তন করছেন। তারই ধারাবাহিকায় এবার নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের মনোনীত প্রার্থী শামীম ওসমানের হাতে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিতে চেয়েছিলেন তাপু। তিনি ফতুল্লা থানা বিএনপির সবশেষ কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। একই সাথে জেলা বিএনপির সহ সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের মনোনয়নবঞ্চিত নেতা শাহ আলমের ঘনিষ্টজন হিসেবেও পরিচিত ছিলেন।
আপনার মতামত লিখুন :