নারায়ণগঞ্জ যেন বিস্ফোরণের শহরে পরিণত হচ্ছে। প্রতিদিনের মতো হঠাৎ বিস্ফোরণের খবর এখন আতঙ্ক ছড়াচ্ছে নগরজুড়ে। ঘনবসতিপূর্ণ এই শিল্পনগরীতে গ্যাস লিকেজ, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট আর মানুষের অসাবধানতাই মূলত এসব ঘটনার জন্য দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। একের পর এক দুর্ঘটনায় অকালেই নিভে যাচ্ছে বহু প্রাণের প্রদীপ। ফায়ার সার্ভিস বলছে, সচেতনতা বৃদ্ধি ও পুরনো গ্যাস লাইনের সংস্কার ছাড়া এ বিপদ থেকে পরিত্রাণের আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের অবহেলা, পুরনো লাইন সংস্কারে গাফিলতি এবং যথাযথ তদারকির অভাবকেই বড় দায়ী করছেন সাধারণ মানুষ। তাদের অভিযোগ-এলাকাভেদে গ্যাস লাইনে বছরের পর বছর ফুটো অবস্থায় পড়ে থাকে, কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত ব্যবস্থা নেয় না। এর মধ্যেই ছোট্ট একটি স্পার্ক বা অসতর্ক আচরণ ঘটিয়ে দেয় বড় ধরনের ট্র্যাজেডি।
সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, নারায়ণগঞ্জে নেই কোনো পূর্ণাঙ্গ বার্ন ইনস্টিটিউট বা বিশেষায়িত দগ্ধ চিকিৎসা কেন্দ্র। ফলে বিস্ফোরণের পর দগ্ধ রোগীদের দ্রুত চিকিৎসা না দিয়ে যানজট ঠেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ বা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিয়ে যাওয়া হয়। এতে অনেক সময় রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয় না। স্থানীয় দুটি সরকারি হাসপাতালে কিছুটা প্রাথমিক চিকিৎসা দিলেও সেখানকার চিকিৎসকরা দ্রুত রোগী ঢাকায় রেফার্ড করে দেন। ফলে এ শহরে ঘটনার পরপরই কার্যকর চিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকায় অনেক প্রাণ অকালে নিভে যাচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জবাসীর দাবি, এখনই শহরে একটি পূর্ণাঙ্গ বার্ন ইউনিট স্থাপন করা জরুরি। তাহলে অন্তত বিস্ফোরণ-পরবর্তী চিকিৎসা সংকটে নতুন করে আর প্রাণহানি ঘটবে না।
সা¤প্রতিক কিছু ভয়াবহ ঘটনা
সবশেষ ৪ সেপ্টেম্বর ভোরে সোনারগাঁয়ের কাঁচপুর মধ্যপাড়া এলাকায় গ্যাস লিকেজ থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণে একই পরিবারের পাঁচজন দগ্ধ হন। এর মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুইজন মারা যান। বর্তমানে তিনজন জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, শুধু গত তিন মাসেই নারায়ণগঞ্জে অন্তত ৮টি বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১১ জন, দগ্ধ হয়েছেন কমপক্ষে ২৫ জন।
এর আগে ২৩ আগস্ট সিদ্ধিরগঞ্জের রনি সিটি সংলগ্ন মুড়ি ফ্যাক্টরিতে গ্যাস বিস্ফোরণে একই পরিবারের নয়জন দগ্ধ হন। তাদের মধ্যে সাতজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
গত ৩ মার্চ রাত ৩টার দিকে সিদ্ধিরগঞ্জের ধনকুন্ডা এলাকায় একটি বসতবাড়িতে গ্যাস লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে নারী-শিশুসহ আটজন দগ্ধ হন।
গত ২৫ অক্টোবর রূপগঞ্জের ডরগাঁও গ্রামের একটি টিনশেড বাসায় জমা গ্যাস থেকে মশার কয়েল ধরাতে গিয়ে বিস্ফোরণে ছয়জন দগ্ধ হন, এদের মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যু হয়।
এছাড়া ২০ অক্টোবর সিদ্ধিরগঞ্জের দক্ষিণ কদমতলী এলাকায় একটি বসতবাড়িতে বিস্ফোরণে কবিতা বেগম (৪৫) দগ্ধ হন। আর গত বছরের ১১ নভেম্বর সোনারগাঁয়ের লাভলী সিনেমা হলের সামনে গ্যাস লিকেজ থেকে হওয়া বিস্ফোরণে দগ্ধ হন সাতজন শ্রমিক।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফীন বলেন, “অসাবধানতার কারণেই এসব দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। নারায়ণগঞ্জের গ্যাস লাইনগুলো দীর্ঘদিনের পুরনো হওয়ায় প্রায় সময় লিকেজ তৈরি হয়। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশ, ফলে ক্ষুদ্র দুর্ঘটনাই পরিণত হচ্ছে প্রাণঘাতী ট্র্যাজেডিতে।”
তিনি আরও বলেন, “একমাত্র সচেতনতা ও সতর্কতাই পারে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধ করতে। তাই প্রত্যেককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে।”
প্রতিনিয়ত এ ধরনের বিস্ফোরণ এবং প্রাণহানির ঘটনায় আতঙ্কে দিন কাটছে নারায়ণগঞ্জবাসীর। তারা বলছেন, একদিকে অবহেলা আর অন্যদিকে অব্যবস্থাপনা এই দুইয়ের মধ্যে পড়ে তারা জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। সবার একটাই দাবি, গ্যাস লাইন সংস্কার ও পর্যবেক্ষণে জরুরি উদ্যোগ, পাশাপাশি একটি পূর্ণাঙ্গ বার্ন ইনস্টিটিউট। না হলে বিস্ফোরণের শহর নারায়ণগঞ্জ থেকে মৃত্যুর মিছিল কমবে না, বরং বাড়তেই থাকবে।
আপনার মতামত লিখুন :