রাজধানীর লাগোয়া জেলা নারায়ণগঞ্জে জাতীয় পার্টির রাজনীতি আজ গভীর অনিশ্চয়তার মুখে। এক সময় আওয়ামী লীগের ছায়ায় থেকেও জাপা এখানে ছিল প্রভাবশালী কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর যেন হাওয়া বদলে গেছে সম্পূর্ণ। একসময় নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান শক্ত করে রাখা দলটির নেতাকর্মীরা এখন কার্যত নিখোঁজ। নেই কোনো দলীয় কার্যক্রম, নেই তৎপরতা, নেই সংগঠন।
বিগত সময় পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের পাঁচটি আসনের মধ্যে দুটি আসনই ছিল জাতীয় পার্টির দখলে—নারায়ণগঞ্জ-৩ (সোনারগাঁও) এবং নারায়ণগঞ্জ-৫ (শহর ও বন্দরের অংশ)। এ দুটি আসন ঘিরেই জাপার রাজনীতি টিকে ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের পতনের পর এই দুই আসনের দুই শীর্ষ নেতা সাবেক সংসদ সদস্য একেএম সেলিম ওসমান ও লিয়াকত হোসেন খোকা দুজনই রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে প্রায় উধাও।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর থেকেই সেলিম ওসমান আত্মগোপনে রয়েছেন। তার অবস্থান নিয়ে কেউ নিশ্চিত নন, তবে একাধিক সূত্র বলছে, তিনি দেশেই আছেন, কিন্তু প্রকাশ্যে আসছেন না। অন্যদিকে লিয়াকত হোসেন খোকা নিজ জেলা ছেড়ে ঢাকার রাজনীতিতে মনোনিবেশ করলেও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আবার জেলার মাঠে কিছুটা সক্রিয় হয়েছেন। তবু তার চারপাশে ভরসার পরিবেশ নেই। দলীয় ভিত্তি দুর্বল, সংগঠন ভাঙাচোরা, আর কর্মীরা দিশেহারা।
জাতীয় পার্টির পতনের মূল কারণ খুঁজতে গেলে সামনে আসে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের দীর্ঘ দিনের আঁতাতের বিষয়টি। মহাজোট সরকারের অংশ হিসেবে ক্ষমতার ভাগিদার হয়ে জাপা নেতৃত্ব নিত তাদের সুবিধা, কিন্তু জনগণের কাছে তারা ক্রমে আওয়ামী লীগের সহযোগী নয় বরং সহযোগী অপরাধীর আসনে বসে যায়। বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ের সহিংস ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে জাতীয় পার্টির অনেক নেতাই মামলার আসামি হন। সেলিম ওসমান ও লিয়াকত খোকা দুজনের নামও ছিল সেই তালিকায়। অনেকেই গ্রেপ্তার হন, কেউ কেউ আত্মগোপনে চলে যান।
ফলে, আজ রাজপথে দেখা যায় না জাতীয় পার্টির কোনো কর্মসূচি বা নেতৃত্ব। সাধারণ মানুষের চোখে তারা আওয়ামী লীগের ‘সহচর’ হিসেবেই পরিচিত এমনকি আওয়ামী লীগের পতনের পরও তাদের ওপর ক্ষোভ কমেনি। অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হলেও সেখানে জাপাকে রাখা হয়নি কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। দলটির নেতারা এখন নেপথ্যে, অনেকে বিদেশে, বাকিরা নিশ্চুপ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নারায়ণগঞ্জে আগামী দিনে জাতীয় পার্টির রাজনীতি করা হবে অত্যন্ত কঠিন। আওয়ামী লীগের পতনের পর যেমন তারা রাজনৈতিক আশ্রয় হারিয়েছে, তেমনি ভোটারদের আস্থা হারিয়েছে বহু আগেই। সোনারগাঁওয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুল্লাহ আল কায়সার হাসনাতের কাছে লিয়াকত খোকার পরাজয়ের পর থেকেই স্থানীয়ভাবে তার গ্রহণযোগ্যতা কমতে থাকে। সাম্প্রতিক সময়েও সেই প্রভাব ফিরে পেতে পারেননি তিনি।
অন্যদিকে, ওসমান পরিবার রাজনীতিতে যে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছিল তা এখন ইতিহাস। ২০১৪ সালে ভাই নাসিম ওসমানের মৃত্যুর পর সেলিম ওসমান উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর টানা দুই নির্বাচনেও জয় পান তিনি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার ফলে টানা দুইবার বিকেএমইএর সভাপতিও হন। কিন্তু আওয়ামী লীগের পতনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক দুই দিক থেকেই কোণঠাসা অবস্থায় পড়েছেন এই প্রভাবশালী রাজনীতিক।
দলীয় চেয়ারম্যান জিএম কাদের কেন্দ্র থেকে দলকে পুনর্গঠনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে জেলা পর্যায়ে তার ডাকে কোনো সাড়া মেলেনি। সংগঠনের ভেতর মনোবল ভেঙে পড়েছে, নেতৃত্বহীনতার কারণে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগও দেখা যাচ্ছে না।
সব মিলিয়ে, নারায়ণগঞ্জে জাতীয় পার্টির রাজনীতি এখন দিকহারা এক যাত্রা। যেখান থেকে ফিরে আসা কঠিন আর না ফিরলে বিলুপ্তি শুধু সময়ের অপেক্ষা।








































আপনার মতামত লিখুন :