দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের সুনিদিষ্ট অভিযোগে দীর্ঘ বছর দল থেকে বহিষ্কৃত ছিলেন মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আতাউর রহমান মুকুল। ২০২৩ সালে থাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিলো। সব শেষে চলতি বছরের ১৯ নভেম্বর বিএনপির প্রথম মনোনীত প্রার্থী মাসুদুজ্জামান মাসুদের বদৌলতে আতাউর রহমান মুকুলের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের পর পরই মাসুদ্জ্জুামান মাসুদের হাতে ফুল দিয়ে তার পক্ষে নির্বাচনে নামেন আতাউর রহমান মুকুল। বড় ভাই সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট আবুল কালাম নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশী থাকলেও তাকে ফেলে মাসুদুজ্জামানের পক্ষে কোমড় বেধে মাঠে নেমেছিলেন তিনি। বন্দরে তিনি বিএনপির নির্যাতিত নেতাকর্মীদের সংবর্ধনার নামে সিরাজদৌলা ক্লাব মাঠে মাসুদুজ্জামান মাসুদকে নিয়ে বিশাল সমাবেশে আয়োজন করেন। একই দিন আতাউর রহমান মুকুলের বাড়ির অদূরেই সমাবেশ করেছিলেন সাবেক এমপি আবুল কালাম সহ মহানগর বিএনপির মনোনয়ন বঞ্চিত অন্য নেতারা। ওই সমাবেশের মধ্য দিয়ে বন্দরের রাজনীতিতে জালাল হাজী পরিবারের বাইরে গিয়ে রাজনৈতিক উত্থানের স্বপ্ন বুনেন আতাউর রহমান মুকুল।
কিন্তু হঠাৎ ১৬ ডিসেম্বর সে সময়কার বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মাসুদুজ্জামান মাসুদ নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিলে মাসুদুজ্জামানের সাথে সাথে আতাউর রহমান মুকুলের রাজনীতিতেও ইতি ঘটে বলে মনে করছেন অনেকে।
এরপর মাসুদুজ্জামান মাসুদকে নির্বাচনে ফিরিয়ে আনতে আন্দোলনে নামেন তার অনুসারীরা। মাসুদুজ্জামানের অনুসারীদের সভায় বক্তব্য রেখে আতাউর রহমান মুকুল বলেন, মাসুদুজ্জামান মাসুদ যদি নিরাপত্তার জন্য নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়ে থাকেন তাহলে আমি বন্দর থেকে ১ হাজার লোক তার সাথে সব সময় রাখবো। নিরাপত্তার কোন ঘাটতি থাকবেনা।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপি থেকে সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট আবুল কালামকে দলীয় মনোনীত প্রার্থী ঘোষণা করে। কালামকে দলীয় প্রার্থী ঘোষণার পর বন্দরের রাজনীতিতে অনেকটাই কোনঠাসা হয়ে পড়েন আতাউর রহমান মুকুল। রাজনীতিতে কোনঠাসা মুকুল এবার আলোচনায় থাকতে সংগ্রহ করেছেন মনোনয়ন।
রোববার ২৮ ডিসেম্বর সকালে নারায়ণগঞ্জ জেলা নির্বাচন অফিস থেকে নিজের জন্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মাসুদুজ্জামান মাসুদের পক্ষে যারা নির্বাচনে নেমেছিলেন তাদের মধ্যে থেকে কেউ মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেনি। সবাই মাসুদুজ্জামানের উপর আস্থা রাখতে চাইছেন, মাসুদুজ্জামান তার অনুসারীদের ধৈর্য্য ধরার আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের প্রত্যাশা শেষ মুহূর্তে কোন না কোন চমক দেখাবেন মাসুদুজ্জামান মাসুদ। কিন্তু আতাউর রহমান মুকুল সেই ধৈর্য্য না দেখিয়ে নিজেই মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। মূলত তিনি আলোচনায় উঠে আসতেই মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। কারণ অতি অল্প সময় পূর্বে তার দল থেকে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এই মুহূর্তে আতাউর রহমান মুকুল যদি আবারো দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে গিয়ে নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হোন বা হওয়ার চেষ্টা করেন তাহলে হয়তো আতাউর রহমান মুকুলে রাজনীতিতে শেষ পেরেক হবে এই মনোনয়ন সংগ্রহ।
এর আগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সেলিম ওসমানের নির্বাচনী প্রচার কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ উঠলে আতাউর রহমান মুকুল, শওকত হাসেম শকু ও মো. গোলাম নবী মুরাদকে বহিষ্কার করে বিএনপি।
আতাউর রহমান মুকুল বন্দর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান। ২০১৪ সালের ২৬ জুন অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের উপনির্বাচনে বিএনপির কোন প্রার্থী না থাকায় ক্ষমতাসীন দল জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী সেলিম ওসমানের পক্ষে পরোক্ষভাবে নিজ সমর্থিত নেতাকর্মীদের নিয়ে কাজ করেন আতাউর রহমান মুকুল। যদিও তৎকালীন সময়ে বিএনপির দলীয় সিদ্ধান্ত ছিল তারা কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। কেন্দ্রীয় এই সিদ্ধান্তকে অনেকটা উপেক্ষা করেই সেলিম ওসমানের পক্ষে কাজ করেন আতাউর রহমান মুকুল। ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর বিজয় র্যালীতে উপস্থিত থেকে ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানের মধ্যেও ছিলেন বিএনপি নেতা আতাউর রহমান মুকুল।
২০১৫ সালের বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারী নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি সেলিম ওসমান বন্দরে সংবর্ধিত হয়ে বক্তব্যে মুকুলকে ‘নাকে খত’ দিয়ে বিএনপি ছেড়ে এলাকাতে ফিরে আসার আহবান জানান। এর সপ্তাহখানেক পরেই মুকুল এলাকাতে ফিরে আসেন। এর পর থেকেই তিনি নিয়মিত এমপি সেলিম ওসমানের পক্ষে কাজ শুরু করেন।
২০১৫ সালের ১৬ জুন নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদের মিলনায়তনে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে জিয়াউর রহমানকে কুকুর বলে গালি দিয়েছিলেন কমান্ডার গোপীনাথ। আর এই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন তৎকালিন বন্দর উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মুকুল। ওই সময় তিনি কোনো প্রতিবাদ করেননি। বরং মুচকি হেঁসেছিলেন।
ক্ষমতাসীন দলের সাথে সমঝোতার অংশ হিসেবে সবশেষ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে সরাসরি মহাজোটের প্রার্থী সেলিম ওসমানের জন্য আতাউর রহমান মুকুল আদাজল খেয়ে মাঠে নামেন। খোদ ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী এস এম আকরামের অভিযোগ ছিল নির্বাচনের দিন অর্থ্যাৎ ৩০ ডিসেম্বর মুকুল বিএনপির ভোটারদের কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়েছেন।
আকরাম নিজেই সেই অভিযোগ করেন। সেই ভোটের ৪ বছর পরে প্রত্যক্ষদর্শী একজন দিয়েছেন বর্ণনা। সেখানে উপস্থিত এক নেতা বলেন, ‘বন্দর থানায় যে কয়জন আওয়ামী লীগের নেতা আছে আমার ভাই শাজাহান মোল্লা, আমার চাচাতো ভাই ফারুক আমাকে ডাক দিয়ে বললো ভিতরে কয়জন নেতা আছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রের ভিতরে গেলাম। আমাকে দেখে তারা হতভম্ব হয়ে যায়। সে কারণে তখনো ভোটকেন্দ্র চুরি হয়ে যায় নাই। তখন আমার ভাইকে বলি তোরা রাতে কেন্দ্র পাহারা দে। আমি এখন ঘুম দেই। তাহলে সকালে ভোটকেন্দ্র পাহারা দিতে পারবো। যেহেতু কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে ভোটকেন্দ্র পাহারা দিতে। তাই আমরা কোনো কিছু কানে না দিয়ে ভোটকেন্দ্র পাহারা দিয়েছি। আমরা নেতাকর্মীদের বলে দেই সবাইকে ১ঘণ্টার মধ্যে ভোট দিয়ে দিতে। যেনো ওরা পরবর্তীতে কোনো ঝামেলা না করতে পারে। আমজাদসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগের নেতারা এই ভোটকেন্দ্র দখল করেছিল। এসময় আতাউর রহমান মুকুল ভাই ওইখানে উপস্থিত হলে তিনি আমাকে বলে তুই বিএনপি হয়ে গেছোস। এখান থেকে চলে যা। তিনি আমাকে গালাগালি করলো। ওনার সাথে তখন রশিদ চেয়ারম্যান ছিল। আমাকে তারা বলে এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ আছে। তিনি না বললে আমাকে ভোটকেন্দ্র থেকে কেউই বের করতে পারতো না। আমি বাধ্য হয়ে ভোটকেন্দ্র ছেড়ে চলে আসি। তখন ওনারাই সিল মারা শুরু করেছে।’
গত বছর নভেম্বরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষনার আগে বিএনপি সরকার পতন আন্দোলনে রাজপথে নামেন। পরবর্তিতে ২৮ অক্টোবর এক দফা বাস্তবায়নে বিএনপি ব্যাকফুটে চলে গেলে মুকুল সহ মহানগর বিএনপি বিদ্রোহী গ্রুপের নেতা আত্মগোপনে চলে যায়। ২৯ অক্টোবর থেকে লাগাতার আন্দোলনে হরতাল-অবরোধে দেখা যায়নি বিদ্রোহী গ্রুপের নেতাদের। বরং ২৬ ডিসেম্বর বন্দরের সমরক্ষেত্রে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী সেলিম ওসমানের নির্বাচনী সমাবেশে বিদ্রোহী গ্রুপের বন্দর থানা বিএনপির আহ্বায়ক হান্নান সরকার, সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক সুলতান আহমেদ ও যুগ্ম-আহ্বায়ক গোলাম নবী মুরাদ হন। তারা সকলেই তৎকালীন মহানগর বিএনপি যুগ্ম আহবায়ক আতাউর রহমান মুকুলের আস্থাভাজন নেতা। দলের নিদের্শনা অমান্য করে জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী সেলিম ওসমানের নির্বাচনী প্রচারে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে মহানগর বিএনপির ৬ নেতাকে বহিষ্কার করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। এক বিজ্ঞপ্তিতে মুকুল সহ ৬জনকে প্রাথমিক সদস্যপদসহ তাদের দলীয় সব পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তারা হলেন নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক আতাউর রহমান মুকুল, ১২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শওকত হাসেম শকু, বন্দর উপজেলা বিএনপি নেতা হান্নান, সুলতান আহম্মেদ, গোলাম নবী মুরাদ।
৫ আগষ্ট আওয়ামীলীগ সরকার পতনের পর মহানগর বিএনপি একটি সমাবেশে মুকুলের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তুলেন বন্দর থানা বিএনপি সভাপতি শাহেনশাহ আহম্মেদ। তিনি বলেন, কানা মুকুল বিএনপি ক্ষতিকারক ওই বিএনপি কে? শেখ হাসিনার প্রেআত্মা কানা মুকুল ও কাউসার হাত থেকে আপনারা সাবধান। ওরা কখনো বিএনপি করে নাই, ওরা বিএনপি সাথে জড়িত ছিল না। কোন মিছিল মিটিংয়ে ছিল না, আপনারা কেউ ওদের কাছে যাবেন না, দূরত্ব থাকবেন। কাউসার স্ট্যান্ড প্রতিষ্ঠান দখল করে যাচ্ছে। আর নাম পড়তাছে আমাদের বিরুদ্ধে। এই কারণে সাখাওয়াত ভাই টিপু ভাইদের বদনাম করার চেষ্টা করতাছে। তাই ওই কানা মুকুল ও কাউসারের থেকে সকলে সাবধান থাকবেন।
আপনার মতামত লিখুন :