গত কয়েক বছরের মধ্যে শুক্রবার ২১ নভেম্বর ভয়াবহ ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে নারায়ণগঞ্জে। এর উৎপত্তিস্থল নারায়ণগঞ্জ লগোয়া নরসিংদিতে। সকাল ১০টা ৩৮ মিনেটে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের এ কম্পনে শহর ও শহরতলীর সর্বত্র চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে। সিদ্ধিরগঞ্জ ও শহরের অন্তত ২০টি ভবনে ফাটল দেখা গেছে। রূপগঞ্জে দেয়াল চাপায় এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
জানা যায়, ভূমিকম্পে শহরের মিশনপাড়া এলাকায় সিগনেচার ভবনের নিচতলায় ২ টি দেয়ালে ফাটল দেখা যায়। এতে ৯ তলা বিশিষ্ট ভবনের ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়।
শহরের মিশনপাড়া এলাকার বাসিন্দা নাহিন মোজতবা সোহান জানান, ৯ তলার উপরে ফ্ল্যাটে ছিলাম। মনে হচ্ছিল এখনই ভবন ভেঙ্গে পড়বে। ভয়ে আমরা সবাই দ্রুত ছাদে উঠে পড়ি।
শহরের চাষাঢ়া এলাকার বাসিন্দা সোলায়মান জানান, ভয়ে তারা ৫ তলা ভবন থেকে দ্রুত নিচে নেমে আসেন। তার ৬০ বছর বয়সে এমন ভূমিকম্প কখনো অনুভূত হয়নি বলেও জানান তিনি।
ভূমিকম্প হয়ে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের একটি স্কুলের ভবনসহ মোট ১৩টি ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে। ফাটল দেওয়া ভবনগুলোর দেয়াল,সিঁড়ি ও কলামে বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি কয়েকটি ভবন দৃশ্যমানভাবে হেলে পড়েছে বলেও জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তবে,এ ঘটনায় কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
স্থানীয়দের মাধ্যমে জানা গেছে, সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদি নতুন মহলায় এলাকায় ২টি ভবন, মুক্তিনগর টায়ার মার্কেট গলিতে ১টি, নিমাইকাশারী এলাকায় ১টি, হীরাঝিল আবাসিক এলাকায় ৩টি, রনি সিটিতে ২টি, ভূমপল্লিতে ১টি,আটি হাউজিং এলাকার ৫নং রোডে ২টি এবং ২নং রোডের ১টি ভবনে ফাটল ধরে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভূমিকম্প শুরু হতেই ভবনগুলো তীব্রভাবে দুলতে থাকে। এতে আতঙ্কিত বাসিন্দারা দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় চলে যান। এসময় কিছু ভবনে ফাটল ধরার সঙ্গে সঙ্গে ভবন সামান্য হেলেও পড়েছে।
দেখা গেছে, হীরাঝিল আবাসিক এলাকার সিটি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজের ভবনের নিচ তলায় বড় ধরনের ফাটল দেখা গেছে। জানা গেছে, ভূমিকম্পকালীন সময়ে স্কুলটির শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি করতে থাকলে সাধারণ মানুষ উপচে পড়া ভিড় জমান।
সিটি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজের ইংলিশ মিডিয়াম শাখার ইনচার্জ কামাল উদ্দিন বলেন, বৃত্তি পরীক্ষা চলাকালে ভূমিকম্পে ভবন হঠাৎ দুলে উঠে। এসময় পুরো স্কুল জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে সব ছাত্র-ছাত্রীকে নিরাপদে নিচে নামিয়ে আনি। কেউ আহত হয়নি। তবে ভবনের সামনে একটি দেয়ালে বড় ফাটল দেখা দিয়েছে।
সিটি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজের অভিভাবক রাজু আহমেদ বলেন, সকালে আমার ছেলে এখানে বৃত্তি পরীক্ষা দিতে আসলে পরীক্ষা চলাকালিন সময় ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়। ওইসময় তাৎক্ষনিক স্কুলের স্যাররা ছাত্রছাত্রীদের বাহির করে দেন। কাউকে আহত হতে দেখেনি।
পাইনাদি নতুন মহল্লা এলাকার ফয়সাল বলেন, আমাদের এলাকার মসজিদের সামনে একটি ভবনে বেশ ফাটল ধরেছে এবং নিচ তলায় একটি থাইয়ের দোকানের কিছু থাইগ্লাস ভেঙ্গে গেছেন।
টায়ার মার্কেট এলাকার সুমন বলেন, ভুমিকম্পের পর টায়ার মার্কেট থেকে একটু পেছনের বাড়িটিতে বড় ফতল ধরেছে এবং এই বাড়ির ভিতরে কিছু টাইলস উঠে গিয়েছে। আমরা আতঙ্কিত হয়ে যাই।
ভূমিপল্লি এলাকার তামান্না নামে এক গৃহিণী বলেন আমাদের এই আবাসিক এলাকায় একটি ভবন ফটল ধরেছে তবে কারো কোনো ক্ষতি হয়নি এতে আমরা খুব ভয় পেয়েছি।
সিদ্ধিরগঞ্জ হাউজিং এলাকার সোলেমান বলেন, আমাদের এখানে ১টি ভবন আরেকটি ভবনের উপর হেলে পরেছে এতে এখন ২টি ভবন ঝুঁকিপুর্ন হয়ে পরেছে। প্রশাসনের উচিৎ ঝুঁকির মাত্রা যাচাই করে এলাকাবসিকে সচেতন করা।
রনি সিটির ৫ নম্বর রোডের বাসিন্দা আকলিমা বেগম বলেন, আমাদের সিঁড়িতে টাইলসে চিড় ধরে গেছে। রান্নাঘরের সকল জিনিসপত্র পড়ে যায়। ভয়ে আমরা সবাই বাইরে বের হয়ে যাই। এখনো ভয় কাটেনি।
আদমজী ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মিরন মিয়া বলেন, আমরা ১৩টির খবর পাইনি। তবে আমাদেরকে ৩-৪ টা এলাকায় থেকে ফোন দেওয়া হলে আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে ভবন হেলে পড়তে দেখিনি। ভবনগুলোতে ফাটল ধরেছিল। তবে কোনো হতাহতের খবর পাইনি।
এ বিষয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহীনুর আলম বলেন, প্রাথমিকভাবে জানা গেছে বেশ কিছু ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে এবং ২টি ভবন হেলে পরেছে। তবে কোনো প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি। মূলত এসব প্রাকৃতিক দুর্যগের কাজ হলো ফায়ার্ভিসের অবুও আমাদের পুলিশ ঘটনাস্থলগুলোতে গিয়েছে।
রূপগঞ্জের গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের ৫ নাম্বার ক্যানেলপাড় এলাকায় নিজ বাড়িতে থাকতেন কুলসুম বেগম ও আব্দুল হক দম্পতি। নবজাতক কন্যা ফাতেমা'কে নিয়ে মায়ের ব্যস্ত সময় কাটতো দিনের পুরোটা সময়। কিন্তু এক ভুমিকম্পে পুরো সংসারটাই এলোমেলো হয়ে গেছে আব্দুল হকের। শুক্রবার সকালে ভূমিকম্পে টিনশেড ঘরের দেয়াল ধসে মারা যায় ছয় মাসের শিশু ফাতেমা আক্তার। এই ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছে মা কুলসুম বেগম ও প্রতিবেশী জেসমিন আক্তার। পরিবার জানায়, ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন থাকা কুলসুমের অবস্থা ভালো নয়। মাথায় আঘাত নিয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন তিনি।
রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, দেয়ালটি বেশ উঁচু। তাছাড়া কোন পিলার ছিলো না এবং রডের অস্তিত্ব ছিলো না। দুর্বল দেয়ালের কারনে ভেঙে পরেছে। আমরা নজরদারি শুরু করছি। এই ধরনের দুর্বল দেয়াল পেলে সেগুলো ভেঙে ফেলা হবে। নিহতের দাফনের জন্য উপজেলা প্রশাসন ২০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছে। আহতদের চিকিৎসা ব্যয় প্রয়োজন হলে তাদের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে উপজেলা প্রশাসন দেখবে।








































আপনার মতামত লিখুন :